অমর একুশের ৭০ বছর

ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনটি এলো। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আজ। আজ ‘মাথা নত না করা’র অমর একুশে। মহান শহীদ দিবস। তবে এবার শুধু দিবস পালন নয়, অমর একুশের ৭০ বছর পূর্তি। দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে এই মাহেন্দ্রক্ষণ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শুধু বাংলা নয়, নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানানোর বিশেষ অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছে ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালীর ভাষা-চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে একই দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উদ্যাপিত হবে ইউনেস্কো ঘোষিত ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে।

১৯৫২ সালের আজকের দিনে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষায় এমনকি বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেছিল বাঙালী। সংগ্রামী ছাত্রদের রক্তে রাজপথ ভেসে গিয়েছিল। একুশের সেই রক্তবীজ বোনা হয়েছিল বাংলার প্রতিটি ঘরে। বায়ান্নর উর্বর বীজ থেকেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। ভাষাকেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্র পাওয়া। বাঙালীর এর চেয়ে বড় কোন অর্জন নেই।

আজ যখন সেই অভূতপূর্ব অর্জন অবিস্মরণীয় ইতিহাস ভুলে থাকার প্রবণতাই বেশি চোখে পড়ছে, যখন সব কিছুকেই খুব সহজে পাওয়া বলে মনে হয়, যখন গা ছাড়া ভাব, ভেতরটা বাজে না, আনুষ্ঠানিকতাই সার, যখন আত্মকেন্দ্রিকতায় আপসে দিন চলে যায়, যখন চাটুকারিতাই সাফল্যের সোপান, শেকড় আকড়ে ধরে থাকা মানুষ যখন দুঃখ কষ্ট নিয়ে কোন রকমে বাঁচে, সুবিধাবাদী ধারাটিই হয়ে যায় মূল ধারা তখন ২১ ফেব্রুয়ারি যেন বাঙালীর সম্বিত ফেরাতে আসে। উদ্ধার করতে আসে। সব বিভ্রান্তি দূর করে সঠিক পথটি দেখিয়ে দিতে এবারও এসেছে অমর একুশে।

আজ সেই অবিনাশী চেতনায় নতুন করে উদ্ভাসিত হওয়ার দিন। নিজেকে ফিরে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। মায়ের ভাষার, নিজস্ব সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার বিশেষ দিবস। সমাজের সকল অন্যায় অসাম্য ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়ার শপথ নেয়ার দিন।

ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালীর প্রথম প্রতিরোধ। নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রাম হিসেবেও এর রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। অমর একুশের দিনে পাকিস্তানীদের সবেচেয়ে ভাল চিনতে পেরেছিল পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনগণ। তাদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না- বুঝতে পেরেছিল। তাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা জোগায়।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল ভারতবর্ষ। একটি ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র হয় তখন। পাকিস্তানও ছিল দুই অংশে বিভক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশ্তু, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালীর অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন: যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি…। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে যায় বাংলার মানুষ। বাঙালীর সে সময়ের আবেগ অনুভূতি ব্যাখ্যা করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা,/তাই কি হয়?’

এর পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। এ অবস্থায় বাঙালীর সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। ১৯৪৮ সালের এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানীদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সকল ভয় জয় করে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। তখন কে ভেবেছিল, মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবি তোলায় ছাত্রদের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালাবে নিজ দেশেরই পুলিশ! অথচ তাই হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। গীতিকবির ভাষায়: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…। মায়ের ভাষার জন্য বিরল রক্তস্রোত। সেই রক্তস্রোতে রাজপথ ভেসে গিয়েছিল।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে কাজ হয় না কোন। কোথায় বরকত কোথায় সালাম/সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে।/যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল/যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/সে জাগে ঘরে ঘরে…। বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে অমর একুশে। আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ উদ্যাপন করবে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে।

এসএইচ-০১/২১/২২ (অনলাইন ডেস্ক)