কে হবেন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী সম্মেলনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হতে যাচ্ছেন ৪২ বছর ধরে দলটির নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতির রানিংমেট হিসেবে কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক? তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা থাকলেও সম্মেলনের মূল লক্ষ্য দ্বাদশ নির্বাচনি বৈতরণী পার করার চ্যালেঞ্জিং নেতৃত্ব উপহার দেওয়া এবং ‘আপ টু বটম ওয়েল কানেক্টেড’ দুর্দিনের সহযোদ্ধারা’ই রানিংমেট হিসাবে নেত্রীর গুডবুকে এগিয়ে রয়েছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে— টানা দুই বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি ছাড়াও আগামী সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান। এর বাইরেও চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে দুই-একজনের নাম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দলীয় ঘরানায় শোনা যাচ্ছে। তবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের বাইরে নতুন কেউ নেতৃত্বে এলে বিগত সম্মেলনগুলোর হিসাবে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলরদের। কিন্তু কাউন্সিলররা বরাবরই এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতির উপর। তাই পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের ওপর।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে- দলের সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন তা নিয়ে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা শুরু হলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি তার রানিংমেট হিসাবে বিশ্বস্ত যোগ্য দুর্দিন দুঃসময়ের পরীক্ষিতদের মধ্যেই ভরসা রাখবেন, এমনটাই মনে করেছন দলের অনেকে ।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘এই সম্মেলনের গুরুত্ব এই কারণে বেশি। এই সম্মেলেনে যারা নেতৃত্বে আসবেন তারা আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ফেইস করবেন। এ নতুন নেতৃত্ব আসার পর আমরা যদি ১৫১ সিট না পাই, তাহলে তো আমরা ক্ষমতায় যেতে পারব না। তাই দলের সফলতা-ব্যর্থতার ভার নতুন নেতৃত্বের ওপরেই বর্তাবে। সে কারণে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চ্যালেঞ্জটি তাদেরই মোকাবিলা করতে হবে।’

এদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে তৃণমূল থেকে দল গোছানো শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। রমজানের ঈদের পর তা আরো জোরালো হবে। এরইমধ্যে দলে যেখানেই দ্বন্দ্ব-বিভেদ, গ্রুপিং-কোন্দল, সেখানেই কেন্দ্রের কঠোর হস্তক্ষেপ করছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এভাবেই সাংগঠনিক বিরোধ মিটিয়ে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে বিজয়ের বন্দরে নৌকার জয় ছিনিয়ে আনতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

তাই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে তৃণমূল থেকে দলকে পুনর্গঠন ও ঢেলে সাজানোর কাজে সাংগঠনিক বিরোধকেই প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা দ্রুত নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

দলকে ঢেলে সাজানোর রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে চলতি মাসে কিংবা ঈদের পরে পরেই গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আর এই বৈঠকে তৃণমূলের সাংগঠনিক প্রতিবেদন ‍উপস্থাপনের পাশাপাশি ডিসেম্বরে দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলের প্রস্তুতি হিসেবে দলের বিভিন্ন উপ-কমিটি গঠন, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। উপজেলা, থানা ও পৌরসভা কমিটি রয়েছে ৬৫০টি। এসব শাখার সম্মেলন চলছে। এছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার কাজও চলছে সমানতালে। চলতি বছর দলের দুই ধাপে সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন করার পরিকল্পনা রয়েছে। জুন-জুলাই এবং অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর— এই দুই ধাপে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একই মঞ্চে ১০ থেকে ১৫ দিনের গ্যাপ রেখে সম্মেলন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটা দল, যার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই দলটির যে কোনো কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে এবারের কাউন্সিলটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আগামীতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনের পূর্বে সারাদেশে যেমন আমরা সংগঠনকে ঢেলে সাজাচ্ছি, তেমনি কেন্দ্রীয়ভাবে দলকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপার তো রয়েছেই। আগামী দিনে এই কেন্দ্রীয় কমিটি (নতুন যে কমিটি হবে) নির্বাচনকে নেতৃত্ব দেবে।’

তিনি আরও জানান, ‘নেত্রী সব সময় কমিটিটা করে থাকেন পুরনো এবং নতুনদের সমন্বয়ে। অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যে দুটোর সংমিশ্রণে কমিটিতে থাকে। এবারের কাউন্সিলেও সেদিকটাতেই নেত্রী খেয়াল রাখবেন আমার বিশ্বাস। আগামী নির্বাচন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জময় হবে। সেই চ্যালেঞ্জময় নির্বাচনে ভোট ভোট যুদ্ধ শুধু সেটিই নয়, যারা নির্বাচনকে ভণ্ডুল করতে চায়, যারা নির্বাচন বিমুখ, যারা গণতন্ত্রের পক্ষে না থেকে ষড়যন্ত্রের পথ অনুসরণ করে তাদের সঙ্গে আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকে এখন পর্যন্ত ২১টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে আওয়ামী লীগের। এ পর্যন্ত সভাপতি হয়েছেন ছয়জন। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ ৯ বার।

১৯৮১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দলের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত চারটি কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর একটি বিশেষ কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি পদে ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলের সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সভাপতি পদে ছিলেন।

১৯৭৪ সালে দশম কাউন্সিলে সভাপতি হন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের গুলিতে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে কাউন্সিলে সভাপতি হন আবদুল মালেক। তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন। এর পরের বছর ১৯৭৭ সালে দলের ১১তম কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হয়।

আওয়ামী লীগ গঠনের পর ১৯৪৯ সালে দলের প্রথম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। এরপর ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৮৭ সালে সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ছিলেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। এরপর জিল্লুর রহমান আবারও দুই মেয়াদে ২০০২ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

২০০২ সালের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন আবদুল জলিল। ছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত। ওইবছর দলের ১৮তম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছরের কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে নবম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। সবচেয়ে বেশি চার বার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিল্লুর রহমান। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ তিনবার; আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও ওবায়দুল কাদের দুই বার করে; প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও আবদুল জলিল একবার করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে ১৯৭২ সালের পর থেকে কেউই টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হননি।

সেই হিসাবে অনেকে মনে করছেন আগামী সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন কেউ দায়িত্বে আসছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক পদে আবারও রাখা হতে পারে। তবে তার শারীরিক অবস্থার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। এদিকে শুক্রবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন ওবায়দুল কাদের।

চলতি মাসে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের অন্তর্গত প্রায় ৮০০ টি ইউনিটে ১৬০০ জন নব-নির্বাচিত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পরিচিত সভা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাতে…। আগামী নির্বাচনে ইনশাল্লাহ আওয়ামী লীগ’ই বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাবে।

এসএইচ-০৩/২৩/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সারাবাংলা)