দেশে বিদেশি জাতের চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে?

“আগে আমরা নারকেল খাবো মানে হল একজন কে ডেকে আনতে হত, সে গাছে উঠতো, সেখান থেকে কয়েকটা ডাব বা নারকেল পাড়তো তারপর খাওয়া হত। এটাই দেখে এসেছি। কিন্তু এখন আমার যে নারকেল গাছ সেখানে আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও নারকেলের উপর বসে মজা নেয়, আনন্দ করে। কারণ নারকেল গাছ লম্বায় তাদের সমান”।

কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার গোপালপুরের কাজী মাহবুবুর রহমান মোহাম্মদ আবু সাঈদ আহমেদ চৌধুরী।

তিনি যে নারকেল গাছটির কথা বলছেন সেটা ভিয়েতনামি নারকেল হিসেবে পরিচিত।

এই গাছ প্রচলিত নারকেল গাছের তুলনায় উচ্চতায় অনেক খাটো। আরো ফলনও বেশি।

দুই হাজার ষোল সালে মি. চৌধুরি তার পুকুর পারে পরিত্যক্ত জমিতে ৫০টা ভিয়েতনামের চারা লাগান।

এরপর ২০১৯ সালে প্রত্যেকটা গাছে ফুল আসা শুরু হয়। এর ৬/৭ মাস পর ডাব এবং নারকেল পেয়ে যান তিনি।

এখন তিনি দুই একর জমিতে এই নারকেলের চাষ করছেন।

সেখানে ৫০ টা গাছে ফল ধরছে আরা বাকিগুলো তিনি চারা তৈরি করেন বিক্রি করনে।

একই সঙ্গে তিনি যেমন ডাব এবং নারকেলের ফলন করছেন তেমনিভাবে তিনি নতুন চারা তৈরির চেষ্টা করছেন। ফলে তার লাভ হচ্ছে দুইভাবে – ফল বিক্রি করে এবং এবং ডাবের চারা বিক্রি করে।

চৌধুরি বলছেন, “এই গাছ হাইব্রিড জাতের হওয়ার কারণে যত্ন একটু বেশি করতে হয়। বেলে-দোঁআশ মাটিতে ভালো হয়। আর আমার মনে হয় এই নারকেল গাছ অনেক পানি খায়। আমি গোবরের কমপোষ্ট সার দিচ্ছি। তবে আমার মনে হচ্ছে আরো ভালো যত্ন করলে গাছ বাঁচানো যাবে”।

একটা গাছ বিক্রি করে তিনি গাছ প্রতি ৫শ থেকে ৭শ টাকা পান। আর ডাব ও নারকেল প্রতিটি বিক্রি করেন অন্তত ৩০টাকায়।

বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, নারকেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল।

তবে আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রচলিত নারকেলগুলো রয়েছে তা থেকে ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে।

তাই নারকেলের ফলন যাতে তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় তাই নতুন এই সম্পূর্ণ ডোয়ার্ফ (খাটো) জাতটির আবাদের ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে।

যথাযথ পরিচর্যা করলে নতুন জাতের এ নারকেল গাছ থেকে ২৮ মাসেই ফলন আসে। ফলনের পরিমাণ আমাদের দেশের জাতের থেকে প্রায় তিনগুণ।

উপযুক্ত পরিচর্যা করলে একটি গাছ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫০টি নারিকেল পাওয়া যায়। উন্নত এ জাতের সম্প্রসারণ করা গেলে আমাদের দেশের নারকেলের উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন কৃষি কর্মকর্তারা।

ভিয়েতনাম থেকে আগত খাটো নারকেল গাছের দুটি জাত রয়েছে:

(ক) সিয়াম গ্রিন কোকনাট: এটি ডাব হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। এ জাতের ডাবের রং কিছুটা সবুজ, আকার কিছুটা ছোট , প্রতিটির ওজন ১.২-১.৫ কেজি। এ জাতের ডাবে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পানীয় পাওয়া যায়। বছরে প্রতি গাছে ফল ধরে ১৫০-২০০ টি।

(খ) সিয়াম ব্লু কোকোনাট: এটিও অতি জনপ্রিয় জাত। এটা উদ্ভাবন করা হয় ২০০৫ সালে। ভিয়েতনামে এ চারা কৃষকের খুবই পছন্দ।

ফলের রং হলুদ, প্রতিটির ওজন ১.২-১.৫ কেজি, ডাবে পানির পরিমাণ ২৫০-৩০০ মিলি। ডাবের পানি খুব মিষ্টি এবং শেলফ লাইফ বেশি হওয়ায় এ জাতের ডাব বিদেশে রপ্তানী করা যায়। বছরে প্রতি গাছে ফল ধরে ১৫০-২০০ টি।

পিট তৈরি : আদর্শ পিটের মাপ হবে ৩ ফুট x ৩ ফুট x ৩ ফুট। গর্ত তৈরির পর প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি পচা গোবর অথবা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে।

মাটিতে অবস্থানরত পোকার আক্রমণ থেকে চারা রক্ষার জন্য প্রতি গর্তে ৫০ গ্রাম বাসুডিন প্রয়োগ করতে হবে। সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।

ভরাটের পর পানি দিয়ে গর্তটাকে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সব সার ও অন্যান্য উপাদান মাটির সঙ্গে মিশে যায় যা চারা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

চারা রোপণ : গর্তের মাঝখানে নারিকেল চারা এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে নারিকেলের খোসা সংলগ্ন চারার গোড়ার অংশ মাটির ওপরে থাকে।

চারা রোপণের সময় মাটি নিচের দিকে ভালোভাবে চাপ দিতে হবে যাতে চারাটি শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

বাড রট-কুঁড়ি পচা : রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ৪ থেকে ৫ গ্রাম প্রপিনেব ও ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক সিকিউর মিশিয়ে কুঁড়ির গোড়ায় স্প্রে করতে হবে ২১ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার।

ফল পচা রোগ : প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত ফলে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

পাতার ব্লাইট : পরিমিত সার প্রয়োগ করলেও যথা সময়ে সেচ এবং নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রোগের আক্রমণ কম হয়। আক্রমণ বেশি হলে প্রোপিকেনাজল গ্রুপের রোগনাশক ১৫ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

গণ্ডার পোকা : আক্রান্ত গাছের ছিদ্র পথে লোহার শিক ঢুকিয়ে সহজেই পোকা বের করা যায় বা মারা যায়। ছিদ্র পথে সিরিঞ্জ দিয়ে অরগানো ফসফরাস গ্রুপের কীটনাশক প্রবেশ করালে পোকা মারা যাবে।

নারকেলের মাইট : গাছ পরিষ্কার করে প্রোপারজাইট গ্রুপের ভার্টিমেক-ওমাইট ৪.৫ মিলি থেকে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

এ জাতের নারকেল হাইব্রিড হওয়ায় এর বীজ দ্বারা চারা উৎপাদন করা যাবে না।

চারা রোপণের পর প্রতি ৩ মাস পর পর নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

চারার গোড়া থেকে ৩০ সেমি দূরত্বে ৩০-৪০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ২০ সেন্টিমিটার গভীর নালায় সারগুলো প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার চারার গোড়া থেকে আগের বারের থেকে ৫-৭ সেন্টিমিটার আরও দূরে সার দিতে হবে। সার দেয়ার পর ১৫-২০ লিটার পানি দিয়ে গাছের গোড়া ভেজাতে হবে। শুকনো মৌসুমে খড় বা কচুরিপানা দিয়ে মালচিং করে নিয়মিত সেচ দিতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজীর আলম বলেন, সরকার প্রথম উদ্দেশ্য দেশীয় চাহিদা পূরণ করা। এবং এই চাহিদা পূরণ করার পর রপ্তানী করার চিন্তা সরকারের রয়েছে।

. আলম বলেন ” ভিয়েতনামের নারকেল আমরা সারা বাংলাদেশে চাষ করতে চাই। আমরা একটা প্রকল্প নিয়েছি। আমাদের হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা হচ্ছে। এবং কৃষকদের চাহিদামত এটা সরবরাহ করা হচ্ছে”।

“এটা যাতে কৃষকরা প্রচুর পরিমাণে রোপন করে এবং আমরা দেশের চাহিদা মেটাতে পারি। আমাদের উপকূলীয় এলাকায় এই নারকেল চাষের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ লবণাক্ত পানিতে অন্য কোন ফসল না হলেও নারকেল গাছ হয়। আমরা সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছি-দেশিয় চাহিদা পূরণ করার পর আমরা বিদেশি রপ্তানী করতে চাই”।

আট-নয় বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম এই নারকেলের চাষ শুরু হয়েছে। তবে সারা বাংলাদেশে কি পরিমান চাষ হচ্ছে সে হিসেব অধিদপ্তর দিতে পারেনি।

এসএইচ-১০/০৯/২২ (ফারহানা পারভীন, বিবিসি)