রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বর্ণিল জীবনের উপাখ্যান

নতুন সমাজব্যবস্থা আর প্রশ্নবিদ্ধ রাজতন্ত্রে বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশদের প্রভাব যখন কমে আসছিল, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের অনেকের জন্য তখন এক ধ্রুবতারা হয়ে ওঠেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উত্তাল সময়ে রাজতন্ত্র ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। দৃঢ় কর্তব্যবোধ এবং সিংহাসন ও ব্রিটিশ জনগণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্পই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়।

ইয়র্কের ডিউক, পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় পুত্র আলবার্ট এবং তার ডাচেস, সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোয়েস-লিয়নের ঘর আলো করে ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনের বার্কলে স্কয়ারের ঠিক পাশের একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি।

১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তার বোন মার্গারেট রোজ। যদিও আন্তরিক এক পরিবেশে বেড়ে উঠা এলিজাবেথ ছিলেন তার বাবা এবং দাদা পঞ্চম জর্জ উভয়ের অত্যন্ত পছন্দের।

মাত্র ছয় বছর বয়সে এলিজাবেথ তার একজন প্রশিক্ষককে বলেছিলেন, তিনি ‘কান্ট্রি লেডি’ হতে চান, যার অনেক ঘোড়া ও কুকুর থাকবে। বলা হয়ে থাকে, খুব ছোটবেলা থেকেই দায়িত্বের এক অসাধারণ বোধ ছিল তার মধ্যে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে উইনস্টন চার্চিল এলিজাবেথকে নিয়ে একবার বলেছিলেন, “আমি ‘একটি শিশুর মধ্যে আশ্চর্যজনক কর্তৃত্বের হাওয়া’ দেখতে পাচ্ছি।”

স্কুলে না-পড়া সত্ত্বেও এলিজাবেথ ভাষাপারদর্শী প্রমাণিত হন এবং সাংবিধানিক ইতিহাস নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন। এমনকি একটি বিশেষ গার্ল গাইড কোম্পানি (প্রথম বাকিংহাম প্যালেস) গঠন করা হয়েছিল, যাতে এলিজাবেথ তার সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারেন।

অশান্ত সময়

১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে ডেভিড হন এডওয়ার্ড অষ্টম। তবে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ভিত্তিতে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করা হয়েছিল তার স্ত্রী, মার্কিন নাগরিক ওয়ালিস সিম্পসনকে। যার ফলে একই বছরের শেষের দিকে পদত্যাগ করেন এডওয়ার্ড অষ্টম।

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ইয়র্কের ডিউক হয়েছিলেন রাজা ষষ্ঠ জর্জ। এই রাজ্যাভিষেকের মধ্য দিয়ে নিজের জন্য কী সংরক্ষিত আছে তার একটি পূর্বাভাস পেয়েছিলেন এলিজাবেথ।

ইউরোপে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পটভূমিতে নতুন রাজা তার স্ত্রী রানি এলিজাবেথকে সঙ্গে নিয়ে রাজতন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু করেন।

১৯৩৯ সালে রাজা-রানির সঙ্গে ডার্টমাউথের রয়্যাল নেভাল কলেজে যান ১৩ বছর বয়সী রাজকুমারী। সঙ্গে ছিলেন তার বোন মার্গারেট এবং ওই কলেজের ক্যাডেট ও তার তৃতীয় চাচাতো ভাই গ্রিসের প্রিন্স ফিলিপ।

বাধাবিপত্তি

এটি প্রথম দেখা ছিল না। কিন্তু ডার্টমাউথের রয়্যাল নেভাল কলেজের ওই সফরেই প্রিন্স ফিলিপের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেছিলেন প্রিন্সেস।

১৯৪৬ সাল অর্থাৎ এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তিনি যে প্রিন্স ফিলিপের প্রেমে পড়েছেন, তখন মোটামুটি তা স্পষ্ট। এমনকি প্রিন্সের ছবিও নিজের ঘরে রেখেছিলেন এলিজাবেথ। তাদের মধ্যে চিঠিও আদান-প্রদান হতো নিয়মিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে সাময়িকভাবে অক্সিলিয়ারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে (এটিএস) যোগ দিয়েছিলেন তরুণ রাজকুমারী। সে সময় লরি চালানোও শিখে নেন। ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি উদ্‌যাপন করতে হাজারো মানুষ যখন বাকিংহাম প্যালেসের সামনে জড়ো হন, সেদিন রাজপরিবারের সঙ্গে যোগ দেন এলিজাবেথ।

কিন্তু যুদ্ধের পর তার প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করার ইচ্ছা নানা বাধার মুখে পড়ে। এলিজাবেথ ছিলেন রাজার আদরের মেয়ে। ফলে ফিলিপের বিদেশি বংশপরিচয়ের কারণে রাজা তার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হননি। ফিলিপের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিষ্ঠিত এই কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা।

১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর পূর্ণতা পায় এলিজাবেথ-ফিলিপের ভালোবাসা। সেদিন ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় বিয়ে করেন তারা। এর মধ্য দিয়ে ফিলিপের উপাধি হয় ডিউক অব এডিনবরা। যদিও নৌবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন তিনি।

বিয়ের পরপরই অল্প কিছুদিনের জন্য ফিলিপের বদলি হয় মাল্টায়। ফলে তুলনামূলক স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করার সুযোগ আসে এলিজাবেথ-ফিলিপের সামনে।

তাদের প্রথম সন্তান চার্লস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালে। আর ১৯৫০ সালে আসে দ্বিতীয় সন্তান অ্যানি। কিন্তু ১৯৫২ সালে এলিজাবেথের বয়স যখন ২৫, তখন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হন যুদ্ধের বছরগুলোতে যথেষ্ট চাপের শিকার হওয়া রাজা ষষ্ঠ জর্জ। এর মধ্যেই বাবার দায়িত্ব পালন করতে ফিলিপকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ সফরে যান এলিজাবেথ। সে সময় চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে এলিজাবেথকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন এলিজাবেথ, যা ছিল বাবা-মেয়ের শেষ সাক্ষাৎ।

এরপরই কেনিয়ার একটি গেম লজে বসে বাবার মৃত্যুসংবাদ পান এলিজাবেথ। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন, কিন্তু ব্রিটেনের নতুন রানি হিসেবে। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কোনো শিক্ষানবিশকাল ছিল না। আমার বাবা খুব অল্প বয়সে মারা গেছেন। ফলে অনেকটা হঠাৎ করেই দায়িত্ব নিয়ে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতে হয়েছিল আমাকে।’

ব্যক্তিগত আক্রমণ

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালের জুনে এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। আর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান দেখতে সেদিন টিভি পর্দার সামনে হাজির হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। যদিও ব্রিটেন তখনও যুদ্ধ-পরবর্তী কঠিন সময় পার করছে। ফলে মন্তব্যকারীরা তখন এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেককে একটি ‘নতুন এলিজাবেথ যুগের’ সূচনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ত্বরান্বিত করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অর্থাৎ রানি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে এলিজাবেথ যখন কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বের হন, তার আগেই ভারতসহ অনেক দেশ ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে যাওয়া প্রথম ব্রিটিশ শাসক ছিলেন এলিজাবেথ। অনুমান করা হয়, তাকে দেখার জন্য তিন-চতুর্থাংশ অস্ট্রেলিয়ান জড়ো হয়েছিলেন। তবে ১৯৫০-এর দশকজুড়ে আরও অনেক দেশ ইউনিয়নের পতাকা নামিয়ে ফেলে।

অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেছিলেন যে নতুন কমনওয়েলথ উদীয়মান ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এবং মহাদেশ থেকে কিছুটা দূরেও সরে যায় ব্রিটিশ নীতি। এ ছাড়াও ১৯৫৬ সালে সুয়েজ পতনের ফলে ব্রিটিশ প্রভাবের পতন ত্বরান্বিত হয়। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সংকটের সময় একসঙ্গে কাজ করার সম্মিলিত ইচ্ছার অভাব ছিল কমনওয়েলথের।

সুয়েজ খাল নিয়ে মিশরের জাতীয়করণের হুমকি রোধ করার চেষ্টায় সেখানে ব্রিটিশ সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত এক অসম্মানজনক পরিণতি ডেকে এনেছিল। যার ফলে পদত্যাগ করতে হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেনকে।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকটে জড়িয়ে পড়েন রানি এলিজাবেথ। তখন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা নির্বাচন করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবে একাধিক পরামর্শের পর হ্যারল্ড ম্যাকমিলানকে নতুন সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান রানি।

লেখক লর্ড আলট্রিনচ্যামের ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ। একটি ম্যাগাজিনের নিবন্ধে তিনি দাবি করেছিলেন, রানি এলিজাবেথের আদালত ‘অতি ব্রিটিশ’ এবং ‘উচ্চ শ্রেণির’। এলিজাবেথ লিখিত বিবৃতি ছাড়া সহজ কোনো বক্তব্য দিতে পারেন না বলেও অভিযোগ ছিল। লর্ড আলট্রিনচ্যামের এমন মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।

যদিও এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছিল যে ব্রিটিশ সমাজ এবং রাজতন্ত্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরোনো ধারা।

‘রাজতন্ত্র’ থেকে ‘রাজপরিবার’

তবে পরিবর্তিত চিন্তাধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন রানি এলিজাবেথ। এ ক্ষেত্রে বড় অবদান ছিল তার স্বামীর।

এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আদালতে ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রথা বিলুপ্ত করা হয় এবং ‘রাজতন্ত্র’ শব্দটি ধীরে ধীরে বদলে হয়ে যায় ‘রাজপরিবার’।

১৯৬৩ সালে হ্যারল্ড ম্যাকমিলান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে আরও একবার রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে আসেন রানি। কনজারভেটিভ পার্টি নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য তখনও কোনো ব্যবস্থা ঠিক করতে না পারায় ‘আর্ল অব হোম’ নিয়োগ করেন তিনি।

রানির রাজত্বকালের মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে সাংবিধানিক সততা রক্ষা । তবে সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে চলে যান তিনি। তার দায়িত্ব সীমিত ছিল আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা ও সরকারকে পরামর্শ দেয়ার মধ্যে।

১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে বাকিংহাম প্যালেস সিদ্ধান্ত নেয় যে আনুষ্ঠানিকতা কমিয়ে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করার জন্য ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।

এর ফলাফল ছিল ‘রয়্যাল ফ্যামিলি’ নামে যুগান্তকারী এক তথ্যচিত্র। বিবিসিকে এই তথ্যচিত্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রানি ও তার পরিবারের সদস্যরা যে অন্য সাধারণ পরিবারের মতো ঘরের নানা কাজ করেন, তা সাধারণ মানুষকে দেখানো।

সমালোচকদের দাবি, বিবিসির ওই তথ্যচিত্র সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে নিজেদের রহস্যময়তাকে ধ্বংস করেছে রাজপরিবার। তবে আদতে তথ্যচিত্রটি সমাজে একধরনের স্বস্তি নিয়ে এসেছিল, যা রাজতন্ত্রের জন্য জনসমর্থন পুনরুদ্ধারেও বেশ সহায়ক হয়।

কেলেঙ্কারি এবং বিপর্যয়

কমনওয়েলথের প্রতি রানির ভক্তি ছিল একটি কঠিন ক্ষেত্র, যার প্রধানও ছিলেন তিনি। আফ্রিকার নেতাদের ভালোভাবে জানতেন রানি এবং তাদের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার জন্য প্রথম ব্রিটিশ রানি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সে পর্যন্তও মোটামুটি ঠিক ছিল সব। কিন্তু এর এক বছর পর থেকে একের পর এক কেলেঙ্কারি এবং বিপর্যয় রাজপরিবারের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

ব্যক্তিগত বিভিন্ন কারণে রানি খবরের শিরোনামে ছিলেন নানা সময়ে। রানির দ্বিতীয় সন্তান, ডিউক অব ইয়র্ক এবং তার স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। বিচ্ছেদে শেষ হয় মার্ক ফিলিপসের সঙ্গে প্রিন্সেস অ্যানির বিয়ে। এরপর প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলসের দাম্পত্যকলহ এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বিচ্ছেদের খবর প্রকাশ হয়।

প্রিন্সেস ডায়নার সঙ্গে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্পর্কের রসায়ন আজও ভাবায় দুনিয়াকে। প্রকাশ্যে একে অন্যের বিরুদ্ধে কখনোই কটূক্তি করেননি তারা। ব্রিটিশ রাজপরিবারে তা ভাবাও যায় না। তবে রানির সঙ্গে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূর হাসিমুখের ছবিতেও বারবার ধরা পড়েছে শত মাইলের দূরত্ব। ডায়না এবং প্রিন্স চার্লসের সম্পর্কের ভাঙন যে দূরত্বকে আরও বাড়ায়।

তবে ডায়নার মৃত্যু ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। রানির ভূমিকা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। যদিও দুই নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারির বিয়ে এবং তাদের সন্তান হওয়ার প্রত্যেকটি মুহূর্ত উপভোগ করেছিলেন রানি।

একই সময়ে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়েও নানা সংকটের মুখে পড়েন রানি। এ ছাড়া বিদেশে, তার রাজত্বের প্রথম দিকে কমনওয়েলথ নিয়ে যে আশা ছিল তা-ও পূরণ হয়নি। নতুন ইউরোপীয় ব্যবস্থা নিয়েও পুরোনো অংশীদারদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ব্রিটেন।

একদিকে রানি যখন রাজতন্ত্রের মর্যাদা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন, তখন রাজপরিবারের কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক অব্যাহত ছিল। তবে সব ছাপিয়ে সমর্থকদের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের অন্যতম সফল একজন শাসক হিসেবেই বিবেচিত।

ক্ষতি এবং উদ্‌যাপন

২০০২ সালে রানির সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে তার মা এবং প্রিন্সেস মার্গারেটের মৃত্যু ছায়া ফেলেছিল দেশজুড়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের উদ্‌যাপনের ওপর। কিন্তু তা সত্ত্বেও এবং রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মহাসমারোহে উদ্‌যাপিত হয় রানির সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধ্যায় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে জড়ো হয় প্রায় ১০ লাখ মানুষ।

এরপর ২০০৬ সালের এপ্রিলে রানির ৮০তম জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে উইন্ডসরের রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার শুভানুধ্যায়ী। এ ছাড়াও ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী, ২০১১ সালের এপ্রিলে রানির নাতি ডিউক অব কেমব্রিজ উইলিয়ামের সঙ্গে ক্যাথরিনের বিয়ে, ২০১২ সালে রানির সিংহাসন আরোহণের হীরকজয়ন্তী এবং সবশেষ চলতি বছরের জুনে উদ্‌যাপিত হয়েছে রানির সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী।

প্রথম ব্রিটিশ রানি হিসেবে আইরিশ প্রজাতন্ত্রে একটি সরকারি সফরও করেন রানি, যা এক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের মেয়াদের রেকর্ড ভেঙে ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আসীন থাকার গৌরব অর্জন করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এর এক বছর পর ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল নিজের ৯০তম জন্মদিন পালন করেন তিনি।

২০১৭ সালে ডিউক অব এডিনবার্গ অবসর নেয়ার পরও দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন রানি। করোনা মহামারির মধ্যে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু হয়। দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গীকে হারানোর এক বছর পর রানির প্ল্যাটিনাম জুবিলি ছিল।

প্রতিশ্রুতি

রানির রাজত্বকালের শুরুর দিকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আনুগত্য ছিল, শাসনামলের শেষ দিকে এসে তা অনেকটাই মলিন হয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ে স্নেহ ও শ্রদ্ধার জায়গা বজায় রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

আফ্রিকা সফরে গিয়ে ৩০ বছর আগে রানি যে অঙ্গীকার করেছিলেন, রজতজয়ন্তী উপলক্ষে তা স্মরণ করে তিনি বলে গেছেন, ‘২১ বছর বয়সে আমি আমার জীবন মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেই ব্রত পূরণ করার জন্য আমি ঈশ্বরের সাহায্য চেয়েছি। আমি এ ব্রত আমার পথচলার শুরুর দিকে করলেও এর একটি শব্দের জন্যও আমি অনুশোচনা করি না কিংবা তা অস্বীকার করি না।’

তবে শোষণ, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নানা বাধাবিপত্তি, ফরাসি রাজপরিবারের পতন এবং আঠারো শতকের শিল্পবিপ্লবের পরও ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বা রাজপরিবার কীভাবে এখনও টিকে আছে, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নতুন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস রাজপরিবারকে কোন পথে নিয়ে যাবেন, সেদিকেই এখন তাকিয়ে বিশ্ব।

এসএইচ-১০/০৯/২২ (অনলাইন ডেস্ক)