সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের দ্বিতীয় স্বামী

এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরার বিনিময়ে ২৫ তম স্ত্রীর কাছে সাম্রাজ্য বেঁচে দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। মার্জিত, শিক্ষিত একইসাথে বুদ্ধিমতি ও কর্তৃত্বপরায়ণ সেই সম্রাজ্ঞীর নাম নূরজাহান। রাজ ইতিহাসে সম্ভবত নূরজাহানই একমাত্র নারী যিনি স্বামী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাথে রূপের উৎকর্ষতা ও তুখোড় কূটনৈতিক বিচক্ষণতা নূরজাহানকে এক স্মরণীয় নামে পরিণত করেছে।

লাহোরের শাহদারা বাগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধির অদূরেই নূরজাহানের সমাধি। তার কবরের উপরে খচিত আছে, এই নগন্য আগন্তুকের কবরের উপর না কোনো প্রদীপ থাক, না কোনো গোলাপ। না কোনো প্রজাপতির পাখা পুড়ুক, না কোনো বুলবুলি গান গাক। সমাধিক্ষেত্রটি তারই তৈরি করানো ছিল, পঙ্কতিটিও তারই কাব্য থেকে নেয়া। এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন পেরিয়ে ক্ষমতার শীর্ষতম স্থানে অধিষ্ঠানের কুশলী কৃতিত্ব নূরজাহান ছাড়া খুব কম নারীই বিশ্ব ইতিহাসে দেখাতে পেরেছেন। তিনি ছিলেন একজন কবি, একজন দক্ষ শিকারি এবং খুবই সৃজনশীল এক স্থপতি। আগ্রায় তার তৈরি করা নকশাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল তার বাবা-মার সমাধি সৌধ। পরে এই স্থাপত্য রীতিই তাজমহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। উপমহাদেশে পারস্য স্থাপত্যকলা, শিল্প, সংস্কৃতি, রন্ধন, চিত্রকলার প্রধান স্থপতি রূপে গণ্য করা হয় সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে।

সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের দ্বিতীয় স্বামী। সম্রাটের ওপর নূরজাহানের অনেক সুপ্রভাব ছিল। অত্যাধিক মদ্যপানের জন্য সবসময় সমালোচিত সম্রাট জাহাঙ্গীর নূরজাহানের প্রভাবেই মদ খাওয়া কমিয়ে দেন। গবিব-দুখী, এতিম ও বিধবাদের প্রতি নূরজাহান সবসময়ই সংবেদনশীল ছিলেন। তার প্রথম স্বামী ছিলেন ইরানি সমরনায়ক শের আফগান আলী কুলি খান ইসতাজলু। রাষ্ট্রবিরোধী ও বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়লে সম্রাটের বাহিনীর হাতে নিহত হন তিনি। নূরজাহান ও শের আফগানের একটিমাত্র কন্যা সন্তান ছিল- লাডলী বেগম।

নূরজাহানের আসল নাম মেহের-উন-নিসা। নববর্ষ বা নওরোজের উৎসবে মেহের-উন-নিসার সাথে দেখা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের। তখন তার রাজত্বের ছয় বছর চলছে। তাৎক্ষণিক বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন জাহাঙ্গীর। সেই মাসেই মেহের-উন-নিসাকে বিয়ে করে মহলে নিয়ে আসেন সম্রাট। নতুন স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রাসাদের নাম দেন ‘নূর মহল’। বিয়ের পাঁচ বছর পর নাম পরিবর্তন করে সম্রাট তার স্ত্রী মেহের-উন-নিসার নাম দেন ‘নূর জাহান’।

মুঘল রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলেন এই নারী। তার ভাই আসফ খানেরই মেয়ে ছিলেন মমতাজ, যার জন্য জাহাঙ্গীরপুত্র শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছিলেন। সিংহাসনের সাথে নিজের সংযোগ বজায় রাখার জন্য তিনি ভাইয়ের মেয়ে মমতাজের সাথে সম্রাটের এক পুত্র শাহজাহানের এবং নিজের প্রথম পক্ষের মেয়ে লাডলী বেগমের সাথে সম্রাটের আরেক পুত্র শাহরিয়ারের বিবাহকে প্রভাবিত করেন।

নূরজাহানই একমাত্র মুঘল সম্রাজ্ঞী যিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামের পাশে নূরজাহানের নাম তখনকার মুদ্রায় স্থান পেতো।

তিনিই সমগ্র মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক, যার স্মৃতি ও অবদান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। লাহোরে জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধের নির্মাতা তিনি, একমাত্র এ স্থাপনাকেই তুলনা করা হয় অনন্য তাজমহলের সঙ্গে এবং এটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা রূপে স্বীকৃত। আগ্রার মুঘল হেরেমে তিনি বাংলা-মহল তৈরি করেছিলেন। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বাংলার জগদ্বিখ্যাত মসলিনকে। ‘আবে রোঁওয়া’ ও ‘বেগম খাস’ নামে মসলিনের দুটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা তিনি। বাংলার সঙ্গে নূরজাহান ছাড়া অন্য কোনো মুঘল রমণীর বিশেষ সংযোগ ছিল না।

সাহসী নূরজাহান শিকারও করেছেন আবার স্বামীর পক্ষে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধের ময়দানেও লড়েছেন। একটি মানুষ খেকো বাঘকে মেরে রক্ষা করেছেন একটি গ্রামের মানুষকে। তিনিই একমাত্র মুঘল সম্রাজ্ঞী, যিনি ‘দেওয়ান-ই-খাস’-এ উপস্থিত হয়ে জনগণের অভাব-অভিযোগ শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কেবলর তারই ছিল রাজকীয় আদেশ সংবলিত ফরমান জারির ক্ষমতা।

নূরজাহানের প্রেম, সাহসিকতা ও ক্ষমতার অনেক কাহিনী ছড়িয়ে আছে। মুঘল প্রাসাদের অন্দরমহলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং আকাঙ্ক্ষার সম্পর্কে রয়েছে বহু উপাখ্যান। নূরজাহানের কাব্যচর্চার সাথে সাথে তার চর্চা করা ঐতিহ্যবাহী পারসিক আতর তৈরির শিল্প, অতি উন্নত অলঙ্কার ও বুনন শিল্প ভারতবর্ষে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুঘল অবদান।

তবে শেষ জীবনে রাজনৈতিক চালে পরাজিত হন তিনি। তার পছন্দের উত্তরাধিকার শাহজাদা খুররম বা সম্রাট শাহজাহান ছিলেন না, ছিলেন অপর পুত্র খসরু। কিন্তু শক্তিবলে শাহজাহান ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই খসরুকে অন্ধ করে হত্যা করেন। স্বাভাবিকভাবেই সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়েন।

জীবনের শেষ ১৮টি বছর নূরজাহানের বন্দিদশার পুরো সময় তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে তার পিতার সমাধিতে দরগাহ তৈরির তদারকি আর কাব্যচর্চা করে দিনাতিপাত করেন। এ সমাধিটি বর্তমানে ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি নামে পরিচিত। যে পারসিক কাব্যটি এ সময় তিনি লিখেন, তার নাম হলো ‘মাখফি’ অর্থাৎ গুপ্ত।

এসএইচ-১৫/৩০/২২ (অনলাইন ডেস্ক)