বৈষম্য-দারিদ্র্যের দেয়াল ভেঙে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের জয়যাত্রা

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। তবে সম্প্রতি নারী ক্রীড়াবিদদের কল্যাণে সাফল্যের ছোঁয়া লেগেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। পুরুষ খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার জমিনে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশের ক্রীড়ামোদি দর্শকদের উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন নারীরা।

দেশের ফুটবলে ১৯ বছরের শিরোপার আক্ষেপ ঘুচিয়ে নারী ফুটবল দলের সাফ শিরোপাজয় কিংবা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইয়ে নারী ক্রিকেট দলের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন গেল এক সপ্তাহে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন পার করেছে স্মরণকালের সেরা সময়। বেশ কয়েকবছর ধরেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের জয়জয়কার। সবসময় পাদপ্রদীপের আলোতে থাকা জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল এখনও কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জিততে না পারলেও দেশের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে নারী ক্রিকেট দলের হাত ধরেই। ২০১৮ সালে সালমা-জাহানারাদের হাত ধরে এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ।

এদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসা ২০২৩ দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ‘কোয়ালিফায়ারের সেরা দুই দল আফ্রিকা বিশ্বকাপের টিকিট পাবে’ এমন সমীকরণ নিয়ে খেলতে নেমে ফাইনালের আগেই বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করে ফেলেছে নিগার সুলতানা জ্যোতির দল। এছাড়া রোববারের (২৫ সেপ্টেম্বর) ফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলার বাঘিনীরা।

অন্যদিকে, দেশের ফুটবলে সবশেষ সাফল্য ২০০৩ সালে সাফ শিরোপা জয়। এরপর থেকে তেমন সাফল্যের দেখা পায়নি বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল। তবে ঠিক বিপরীতচিত্র নারী ফুটবলে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ধারাবাহিক সাফল্যের পর নারী সাফের ২২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই সঙ্গে দেশের ফুটবলেরও ১৯ বছরের শিরোপার আক্ষেপ মিটল।

বেতন বৈষম্য

আনন্দের মধ্যেও কিছুটা বিশাদ আছে। আছে না পাওয়ার ক্ষোভ কিংবা পদে পদে বঞ্চনার গল্প। বেতন বৈষম্যসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ খেলোয়াড়দের তুলনায় অনেক সংগ্রাম পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে নারী ক্রীড়াবিদরা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের একের পর এক সাফল্য। বাইশগজে যেমন মাতাচ্ছেন জ্যোতি-সালমারা, তেমনি ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের ত্রাস হচ্ছেন সাবিনা-কৃষ্ণারা। এছাড়া দেশের আর্চারিতেও দিয়া সিদ্দিকীদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক সাফল্য আসছে। তবে এমন উৎসবের মুহূর্তে কথা উঠছে পুরুষ ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে নারী ক্রীড়াবিদদের বেতন বৈষম্য ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়েও।

পুরুষ ক্রিকেটে ‘এ’ প্লাস ক্যাটাগরি থাকলেও নারী ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি ‘এ’ গ্রেড। ‘এ’ প্লাস ক্যাটাগরির একজন পুরুষ ক্রিকেটারের বেতন ৪ লাখ টাকা। এদিকে, ‘এ’ গ্রেডের একজন নারী ক্রিকেটারের বেতন যেখানে ৫০ হাজার টাকা, সেখানে পুরুষ ‘এ’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন ৩ লাখ টাকা। নারী ‘বি’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন যেখানে ৪০ হাজার টাকা, সেখানে পুরুষ ‘বি’ গ্রেড ক্রিকেটারের বেতন ৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া নারী ‘সি’ গ্রেডের একজন ক্রিকেটারের বেতন মাত্র ৩০ হাজার টাকা।

বৈষম্যের আরেকটা দিক, একদিনের ম্যাচে পুরুষ ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি যেখানে ৩ লাখ টাকা, সেখানে নারী ক্রিকেটাররা পান মাত্র ৯ হাজার টাকা।

এ তো গেল ক্রিকেট, ফুটবলের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও খারাপ। যদিও এটাও ঠিক যে, পুরুষ ফুটবলারদের কোনো বেতন দেয় না বোর্ড। তাদের উপার্জন মূলত ক্লাব থেকেই আসে। কিন্তু বৈষম্যটা সেখানেও। শীর্ষ ক্লাবগুলোতে একজন পুরুষ ফুটবলার বছরে যেখানে ৫০-৬০ লাখ টাকা আয় করতে পারেন, সেখানে নারী ফুটবলারদের আয়টা বড়জোর ৩-৪ লাখ টাকা।

এছাড়া বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে নামমাত্র একটা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন ফুটবলাররা। যেখানে ‘এ’ ক্লাস ফুটবলাররা পান মোটে ১০ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাসের ফুটবলাররা যথাক্রমে পান ৮ ও ৬ হাজার টাকা করে।

বেতন বৈষম্য নিয়ে সাবেক নারী ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসি বলেন, আপনি যদি পাশের দেশগুলোর দিকে তাকান, সেখানে নারী ক্রীড়াবিদরা অনেক সুবিধা পান, সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। ভারতের মতো দেশে খেলার বাইরে চাকরি করারও সুযোগ থাকে নারী ক্রিকেটারদের। যাতে আর্থিকভাবে আরও স্বচ্ছল থাকতে পারেন ক্রিকেটাররা।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে পুরুষ ও নারী খেলোয়াড়দের বেতন ও ম্যাচ ফিতে অনেক গ্যাপ আছে। তবে এশিয়া কাপ জেতার কারণে নারী ক্রিকেটারদের যেমন বেতন বেড়েছে, আশা করি এখন নারী ফুটবলারদেরও বাড়বে।

সংগ্রামী জীবন থেকে বাংলাদেশের আশার প্রদীপ

সাফ শিরোপা জিতে প্রশংসায় ভাসছেন নারী ফুটবলাররা। তবে এমন সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে অনেক সীমাবদ্ধতা ও বাধার দেয়াল পেরুতে হয়েছে ফুটবলারদের। চ্যাম্পিয়ন এই দলটার অনেকে এই পর্যন্ত এসেছেন বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে কিংবা কেউ আবার পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। যেমনটা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক পোস্টে বলেছিলেন ফুটবলার সানজিদা আক্তার। তিনি লেখেন, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আছে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত।’

চলুন, কয়েকজন ফুটবলারের সংগ্রামের গল্প শোনা যাক। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার এক অজপাড়া গ্রাম মন্দিরঘোনা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র বাহন। শুকনো মৌসুমেও নেতাই নামক খরস্রোতা নদীটি পানিতে থৈ থৈ করে, তাই অনেকটা কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় এলাকার মানুষজনকে। তবে অজপাড়াগ্রাম হলেও এই গ্রামটিতে যেন চাঁদের আলো হয়ে এসেছে এক অদম্য মেয়ে। সে আর কেউ নন, সাফজয়ী ফুটবলার মারিয়া মান্দা। শহরের সব আলো-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন এই অদম্য কিশোরী। তার লড়াইয়ের গল্প যে কারও চোখ ভেজাবে। গারো পাহাড়ের কোলে এক গারো পরিবারে জন্ম হয় মারিয়ার। বাবা অনেক আগেই মারা যাওয়ায় সংসার চলে শুধু মায়ের রোজগারে। মায়ের রোজগারের পথ ছিল অন্যের বাড়িতে কাজ করা। টানাপোড়েনের জীবনেও ফুটবল নিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অদম্য মারিয়া।

এছাড়া আরেক ফুটবলার আনাই মগিনির গল্পটা মন ভোলাবে যে কাউকেই। দেশের পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার মেয়ে আনাইয়ের মা-বাবা এবং চার বোন ও তিন ভাই মিলে বেশ বড় পরিবার। মা-বাবা দুজনই কৃষক। আর ভাইয়েরা মিস্ত্রি। এমন পরিবারেই জন্ম এই স্বর্ণকিশোরী মগিনির। ২০১১ সালের বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে আনাই মগিনির শুরু। এরপর খাগড়াছড়ি জেলা দলের হয়ে খেলে ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়া। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে এখন তিনি জাতীয় দলে খেলছেন। বয়স ১৯ না পেরোনোয় বয়সভিত্তিক দলেরও নিয়মিত মুখ আনাই। এছাড়া তার যমজ বোন আনুচিং মগিনিও জাতীয় দলে খেলেন। বাংলাদেশের আশার প্রদীপ।

শুধু মারিয়া বা আনাই মগিনি নন, শিরোপাজয়ী মেয়েদের প্রায় সবার গল্পও প্রায় একই। দেশের ফুটবলে মেয়েদের এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের। এই এক স্কুল থেকেই প্রায় ১২-১৩ জন খেলোয়াড় খেলছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে। এছাড়া প্রতিবছরই নতুন করে আরও অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। যেন নারী ফুটবলার তৈরির আস্ত কারখানা। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা গ্রাম থেকে, একটা স্কুল থেকে বছরের পর বছর এত নারী ফুটবলার উঠে আসছে কীভাবে! তাদের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মফিজ স্যারের হাত ধরে উত্থান হয় এ মেয়েদের।

প্রথমে ২০০৯ সালে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা ফজিলাতুন্নেছা কাপের জন্য দল গঠন করে। যদিও প্রথম দুই বছর তারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। পরে আরও কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে তারা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ওই মেয়েরা বড় হয়ে কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ে যান। তারপর একে একে যোগ দেন জাতীয় দলে। অথচ ওদের প্রায় সবারই অভাবের সংসার। কারও মা রাস্তায় কাজ করেন। কারও বাবা রিকশা চালান। কারও বা আবার শ্রমজীবী পরিবার। সে সময় যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো, তারা কী চায়, উত্তর পাওয়া যেত, পেট ভরে খেতে চাই। বেশি করে খাবার দিয়ে দিন, বাড়িতে সবাই মিলে খাব।’ খাবারের কষ্টে ফুটবল খেলা শুরু করা অদম্য মেয়েরা এখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রকে করেছে গর্বিত।

অন্ধকার পেরিয়ে আশার আলো
অন্য দেশের নারী ক্রিকেটারদের তুলনায় অপ্রতুল হলেও বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন নারী ফুটবলাররা। তবে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা সাফ চ্যাম্পিয়নদের বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন।

আশা করা যাচ্ছে, আজকের সফল নারী ক্রীড়াবিদদের দেখে ভবিষ্যতে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।

এসএইচ-২৩/২৬/২২ (স্পোর্টস ডেস্ক)