মোবাইলে ইন্টারনেট সেবার মান আরও খারাপ হবার আশঙ্কা!

দেশে শুধু ডিসেম্বর মাসেই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তার আগের মাসের তুলনায় প্রায় ২৮ লাখ কমেছে। এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও অপারেটর ও বিশ্লেষকদের আশংকা যে অবকাঠামোগত সুবিধা দ্রুত বাড়ানো না হলে মোবাইলে ইন্টারনেট সেবার মান আরও খারাপ হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।

মোবাইল ইন্টারনেটের বিপরীতে ডিসেম্বরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়লেও তাতেও কাঙ্ক্ষিত গতি পাওয়া যাচ্ছে না এবং এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্তকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফোর জি সেবা চালুর পর নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক, ভিডিও ডাউনলোড, লাইভ স্ট্রিমিং সহ নানারকম সেবা সাধারণ মানুষ পাবে বলে সরকার ও মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রচার করেছিলো।

টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বাস্তব পরিস্থিতি হলো সরকার অবকাঠামো তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় শহরের বাইরে ফোরজি সেবা পাওয়া যায় না।

মোবাইল কোম্পানিগুলোও বলছে স্পেকট্রাম, অপটিক্যাল ফাইবার, টাওয়ার সহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকার কারণেই প্রত্যাশিত সেবা তারা দিতে পারছে না।

যদিও বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বলছেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

“অপারেটররা গ্রাহকদের ফাঁকি দেয়ার জন্য এসব বলে। আমরা আগামী ২২শে ফেব্রুয়ারি তাদের সাথে বসবো। যেসব অভিযোগ উঠেছে সেবার ক্ষেত্রে এর সবই সত্য। তাদের রেগুলেশন্স মেনে প্রতিশ্রুত সেবা অবশ্যই দিতে হবে” বলছিলেন তিনি।

একটি বেসরকারি এনজিওতে কাজ করেন সালমা বেগম। করোনা মহামারির কারণে বর্তমানে তাকে দিনে অন্তত দুটি মিটিং করতে হয় অনলাইনে।

“আমি আমার ফোন ব্যবহার করে জুমে মিটিং করেছিলাম কিছুদিন। কিন্তু নেটওয়ার্কের এতো সমস্যা হচ্ছিলো যে শেষ পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড লাইন নিয়েছি আলাদা করে,” বলছিলেন তিনি।

শামসুন্নাহার নামে একজন শিক্ষক বলছেন, তিনি অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন প্রায় দেড় বছর ধরে – কিন্তু ইন্টারনেটের গতি এতো কম পান তিনি যে অনেক দিনই তাকে ক্লাস পর্যন্ত স্থগিত করতে হয়েছে।

“ঢাকার বাইরে থাকি। এমনিতেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ঝামেলা করে। ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি ইন্টারনেটের অবস্থা ভয়াবহ। তবুও চালিয়ে যেতে হচ্ছে আর কি,” বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ দেয়া তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এধরনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৩৮ লাখ – যা তার আগের মাসেই ছিলো ১১ কোটি ৬৫ লাখ। ।

তবে সার্বিকভাবে ২০২১ সাল শেষে মোট ইন্টারনেট গ্রাহক আগের বছরের তুলনায় এক কোটিরও বেশি বাড়লেও – গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসেই ক্রমান্বয়ে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে আসছিলো।

ইন্টারনেটের গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’ মতে, বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে (জুন ২০২১)।

বাংলাদেশের পেছনে ছিলো তখন শুধুমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভেনেজুয়েলা।

মুঠোফোন গ্রাহক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, কয়েকটি সমস্যা এখন নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এগুলো হলো: যে গতি দেয়ার কথা সেটি পাওয়া যায় না, আর ডেটার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়া। যেমন ১০ জিবি ডেটা ক্রয় করলে সেটার একটা মেয়াদ বেঁধে দেয়া থাকে প্যাকেজে।

“আদালত থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর বিটিআরসি ক্রয় করা অব্যবহৃত ডেটা গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিতে বলেছিলো। কিন্তু সেটিও খুব এটা কার্যকর হয়েছে বলে মনে হয় না,” বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, ব্রডব্যান্ডের ক্ষেত্রে ‘এক দেশ-এক রেট’ নীতি কার্যকরের কথা বলা হলেও সেটি এখনও হয়নি এবং বন্ধ হয়নি বাফারিংও।

জানা গেছে, ব্রডব্যান্ডের ক্ষেত্রে সাধারণত ১০এমবিপিএস গতি থাকার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ নিজেই এটি ৫ এমবিপিএস নির্ধারণ করেছে রেখেছে যা ব্যবহারের অনুপাত ঠিক করা আছে ১:৮। অর্থাৎ এ ধরনের একটি লাইন এক সাথে আটজন ব্যবহার করতে পারবেন।

“ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বঞ্চিত হওয়ার দায় সম্পূর্ণ সরকারের। কারণ সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েই মোবাইল কোম্পানি গুলো সময় বেধে দিয়ে গ্রাহকদের কাছে প্যাকেজ বিক্রি করছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক,” বলছিলেন আবু সাঈদ খান।

মোবাইল ফোন গ্রাহকদের একটি সংগঠন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন গ্রাহকদের অপারেটররা ইন্টারনেট সেবার নামে যা খুশী তাই করছে – কিন্তু সরকার কোন ব্যবস্থাই নিতে পারছে না বলেই মনে করেন তারা।

কী ধরণের সেবা ঠিক মতো পাচ্ছেননা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা?

বিশ্লেষক ও গ্রাহকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে কয়েকটি সমস্যার মুখে মোটামুটি সব ধরণের গ্রাহককেই পড়তে হচ্ছে। এগুলো হলো:

১. গতি পাওয়া যায় না। অর্থাৎ যে গতি দেয়ার কথা সেটা দেয় না।

২. ডেটার মেয়াদ নির্দিষ্ট হওয়ায় সব ডেটা ব্যবহার করা যায় না।

৩. অব্যবহৃত ডেটা ফেরত দেয়ার থাকলেও সেটা পাওয়া যায় না।

৪. ‘কল ড্রপ’ একটি মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

৫. ফোরজি থেকে নেটওয়ার্ক ঘন ঘন টুজিতে চলে যাওয়া।

বিটিআরসির হিসেবে ২০২১ সালে ৫২ দশমিক ৫৯ কোটি বার কল কেটে যাওয়ার (কল ড্রপ) শিকার হয়েছেন দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকেরা। এতে মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের প্রায় ১৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মূলত ‘কল ড্রপ’ তখনই ঘটে যখন কোনও মোবাইল ফোন অপারেটরের সিগন্যাল দুর্বল থাকে।

আবার ‘কল ড্রপ’ হলে গ্রাহককে ফ্রি টকটাইম দেওয়ার কথা মোবাইল ফোন অপারেটরদের। কিন্তু টেলিকম কোম্পানিগুলো সেটিও ঠিক মতো দিচ্ছে না।

বিটিআরসি কল ড্রপের প্রধান কারণ হিসেবে মোবাইল অপারেটরদের ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে তাদের টাওয়ার সংযোগ করার ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে।

ফোন কোম্পানিগুলো বলছে, ফাইবার অপটিক ক্যাবল তারা পর্যাপ্ত পাচ্ছে না।

যদিও বিটিআরসি বলছে, ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করলে কল ড্রপ করা যাবে না বলেই কোম্পানিগুলো সেটি নিচ্ছে না।

“আমাদের ১ লাখ ৪৩ হাজার কিমি ফাইবার অপটিক ক্যাবল আছে কিন্তু তারা সেটি ব্যবহার না করে মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করতে চায় ফাঁকি দেয়ার জন্য। জিপি মাত্র ১২ ভাগ আর রবি ১৮ ভাগ ব্যবহার করছে। এটি ব্যবহার করতে হলে তাদের সেটি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে কিনে নিতে হবে,” বলছিলেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান।

টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান বলছেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে বিটিআরসির তথ্য অসম্পূর্ণ।

তিনি বলেন, “বিটিআরসির উচিত প্রতিমাসে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ বা প্রবৃদ্ধি জানানো উচিত। কিন্তু সেটা বিটিআরসি কখনোই জানায় না।”

মিস্টার খান বলেন, একই নামে মাল্টিপল ইউজার থাকায় কখনো কখনো ব্যবহারকারী কমতে পারে। তাছাড়া মহামারির কারণে মানুষের আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয় আছে। আর অনেকে এখন ফোনে ডেটা ব্যবহার না করে ওয়াইফাই ব্যবহার করে।

তিনি বলেন অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে চারটি বড় শহর ছাড়া কোথাও ইন্টারনেট সার্ভিস ভালো পাওয়া যায় না। আবার সরকারি বিধিনিষেধের কারণে কোম্পানিগুলো ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপন করতে পারে না।

“এসব পলিসিগত ভুলের জন্য খেসারত দিতে হয় ব্যবহারকারীদের। আমার আশংকা এগুলোতে দ্রুত পরিবর্তন না আনলে ইন্টারনেট সার্ভিস দিন দিন খারাপ হবে,” বলছিলেন তিনি।

গ্রামীণ ফোন ও রবি’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাঠানোর কথা জানিয়েছেন।

তবে প্রতিষ্ঠান দুটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দরকারি অবকাঠামো তাদের না দেয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশংকা করছেন তারাও।

“ফাইবার অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের অবস্থা খারাপ। স্পেকট্রাম নাই। ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিন্তু ক্যাপাসিটি কম। বেশি দাম দিয়েও প্রত্যাশিত পরিমাণ স্পেকট্রাম পাওয়া যায়নি। কিভাবে আশা করবেন যে সেবা ভালো হবে?” – বলছিলেন একটি ফোন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা, যিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

বিটিআরসিকে এসব সমস্যা তারা জানিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন বহুবার জানানো হয়েছে।

“কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ আমাদের এসব কথা ভালোভাবে নেয় না। নেতিবাচকভাবে দেখা হয় সবকিছু। এসব কারণে মনে হয় না শিগগিরই অবস্থার পরিবর্তন হবে,” বলছিলেন তিনি।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বলছেন, তারা সারা দেশে টেস্ট করে কোম্পানিগুলোকে জানিয়েছেন যে কোথায় কেমন সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

“আমরা বাংলা লিংক, রবিকে জরিমানা করেছি। ইন্টারনেট নিয়ে সব অভিযোগই সত্যি। রেগুলেটর হিসেবে আমরাও সেজন্য অপারেটরদের ওপর চাপ তৈরি করছি। একটা স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটার আছে সেটা মেনে ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু তারা ফাঁকি দিতে চায়। আমরা ২২ তারিখের মিটিংয়ে তাদের সাথে এগুলো নিয়ে কথা বলবো,” বলছিলেন তিনি।

এসএইচ-২৮/১০/২২ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)