টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি কাজে আসছে না!

বিপুল বিনিয়োগ করে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ (এমওটিএন) প্রকল্পের সুফল পায়নি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাক্সেস গেটওয়ে (এজিডব্লিউ) এক্সচেঞ্জ এবং জিপন প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়। তবে কানেকটিং নেটওয়ার্কের আধুুনিকায়ন হয়নি। এর সঙ্গে আছে নিম্নমানের গ্রাহকসেবা আর দক্ষ জনবলের অভাব। সব মিলিয়ে প্রকল্পের উন্নত টেলি যোগাযোগব্যবস্থার কাক্সিক্ষত ফল মিলছে না। জানা গেছে, এমওটিএন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি।

দেশের বিটিসিএলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোর অধিকাংশ পুরনো, সেকেলে প্রযুক্তির। এগুলোর যন্ত্রাংশ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় ক্রমান্বয়ে গ্রাহকসেবার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বিটিসিএলের আইপি কোর সিস্টেমও দীর্ঘদিনের পুরনো এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন। এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী বিস্তৃত একটি আধুনিক ও শক্তিশালী আইপি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।

২০১৪ সালের ১৬ মে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৫৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় জুলাই ২০১৭ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত। এর পর সেপ্টেম্বর ২০২০-এ প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩১৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা করা হয়। বাস্তবায়নকাল বাড়ানো হয় জুন ২০২৩ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ফের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে বিটিসিএল কিংবা তাদের সেবাগ্রহীতারা প্রকল্পের কাক্সিক্ষত সুফল পায়নি।

তবে তা মানতে রাজি নন প্রকল্প পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের অনেক সুফল আছে। কিছু কিছু জায়গায় সুফল পেতে আরেকটু সময় লাগবে। এটা ঠিক যে, বিটিসিএলের জনবল সংকট আছে। এ জন্য কিছু জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। গ্রাহকদের সেবার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে বলেও মনে করি আমরা।’

প্রকল্পটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এতে বলা হয়েছে এমওটিএন প্রকল্পে ডিপিপি প্রণয়নে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। পুরনো এক্সচেঞ্জগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য ৪ লাখ ৩১ হাজার ১২০ গ্রাহক ধারণক্ষমতার ৫৯৮ এজিডব্লিউ এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হলেও মাত্র ৩২.৮৭ শতাংশ টেলিফোন রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রযুক্তির এক্সচেঞ্জ মান ভালো হলেও পুরনো ত্রুটিপূর্ণ নেটওয়ার্কের কারণে নতুন সংযোগ হচ্ছে না। ধারণক্ষমতার মাত্র ১.৩ শতাংশ নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ডিজিটালে রূপান্তরিত টেলিফোনগুলোও ভালো চলছে না। এক্সচেঞ্জের ধারণক্ষমতার একটি বড় অংশ কার্যত অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত এজিডব্লিউ এক্সচেঞ্জ ব্যবহারের নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে ৫৮৩৯টি, যা ধারণক্ষমতার ১.৩৫ শতাংশ। ডিজিটাল রূপান্তর করা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৫৭টি সংযোগ, যা ধারণক্ষমতার ৬৪.৩৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ৭৩ হাজার ৯৪৪ গ্রাহক ধারণক্ষমতার জিপন টেলিফোনের মধ্যে নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ১১৮টি, যা ধারণক্ষমতার ১৭.৭৪ শতাংশ। তবে বিটিসিএলের গ্রাহকসেবার মান অন্যান্য প্রাইভেট অপারেটরের তুলনায় নিম্নমানের। প্রচারও নেই। সেবা প্রদানে মগবাজার কেন্দ্র থেকে স্থানীয় গ্রাহকসেবা ইউনিটগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। সবপর্যায়ে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট ঘাটতিও আছে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ছিল ধীরগতি। ৩ বছরের প্রকল্পের মেয়াদ ছয় বছর গড়িয়ে গেলেও খরচ হয়েছে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৭৬.২৩ শতাংশ।

অ্যাক্সেস গেটওয়ে (এজিডব্লিউ), পোর্টাল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে প্রবেশের সুযোগ নিশ্চিত করে। এর যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার কারণ উপজেলাপর্যায়ে আধুনিক এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হলেও নতুন ক্যাবল নেটওয়ার্ক তৈরি হয়নি। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি নেটওয়ার্ক না থাকায় নতুন সংযোগ দেওয়া যায়নি। টেলিফোনগুলো বিদ্যমান পুরনো ত্রুটিপূর্ণ কপার ক্যাবল নেটওয়ার্কে চালু করায় প্রায়শঃ টেলিফোন বিকল থাকে।

আরেকটি প্রযুক্তি হচ্ছে গিগাবিট প্যাসিভ অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক (জিপন)। টেলিফোন অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল নেটওয়ার্কে গিগাবিট গতিতে ট্রিপল-প্লে (ভয়েস, ডেটা ও ভিডিও পরিসেবা) সেবা প্রদানের স্থাপত্য কাঠামো। এর উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধার জন্য গ্রাহক চাহিদার শীর্ষে। পর্যাপ্ত এক্সচেঞ্জ না থাকায় জিপন সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। এর ইন্টারনেট কাভাররেজ এরিয়াও কম। তার পর জিপন প্রযুক্তির ইন্টারনেট ভাড়া আইএসপিদের তুলনায় বেশি। এ নিয়ে গ্রাহকদের আপত্তি রয়েছে।

অভিযোগ আসছে, কথোপকথনের সময় মাঝে মাঝে ভয়েজ কেটে কেটে যায় এবং ভয়েজ লেভেল লো হয়ে যায়। বড় সমস্যা হচ্ছেÑ গ্রাহক প্রান্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জিপন বিকল হয়ে পড়ে এবং ইন্টারনেটও কাজ করে না। গ্রাহক প্রান্তের বিদ্যুৎ নির্ভরশীলতা দূর করতে হবে। গ্রাহক প্রান্তের রাউটারে ব্যাটারি ব্যাকআপ রেখে এ সমস্যা দূর করা যেতে পারে।

বিটিসিএলের এলএলআই (লিজড লাইন ইন্টারনেট) কলচার্জ অনেক বেশি। এটি কমানো হলে গ্রাহকসংখ্যা বাড়বে। এ সংযোগ সাধারণ গ্রাহককে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এসএইচ-০৭/০৭/২৩ (প্রযুক্তি ডেস্ক)