দেশে এক যুগ ধরে বিতর্ক চলমান গণতন্ত্র নাকি উন্নয়ন

গণতন্ত্র নাকি উন্নয়ন – এ রকম একটি বিতর্ক বাংলাদেশে গত এক যুগ ধরেই চলমান। আর এই বিতর্কের মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একটি স্লোগান।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ ধারনা চালু করেছে। এ ধারণার একটি ব্যখ্যা যেমন আওয়ামী লীগের কাছে রয়েছে, তেমনি এটির তীব্র বিরোধিতাও আছে।

উন্নয়নের বিষয়টি সামনে এনে সরকার গণতন্ত্রের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায় বলে অনেকে মনে করেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন একটি আরেকটির বিকল্প হতে পারেন না।

‘উন্নয়নের গণতন্ত্র, শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র’ – এমন শ্লোগান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে।

গত এক এক যুগ ধরে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা ও তাদের সমর্থকরা, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি- এমন ধারণার পক্ষে জোরালো কথা বলেছেন।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর আছে কি না সেটি নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে যখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করে তখন ক্ষমতাসীনরা অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে।

“উন্নয়নের গণতন্ত্র নামে যে ডিসকোর্সটি চালু করা হয়েছে সেটা অনেকটাই আসলে পাশ কাটানোর প্রবণতা এই ডিসকোর্সের মধ্যে রয়েছে। ” – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও বিশ্লেষক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলছিলেন ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ ধারণাটি কেন সামনে আসলো।

তিনি বলেন, তাত্ত্বিকভাবে উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য নয়। কিন্তু উন্নয়ন যদি সবার মাঝে সমানভাবে হতো কিংবা উন্নয়ন থেকে সবাই যদি সমানভাবে উপকৃত হতো তাহলে উন্নয়নের গণতন্ত্র ধারণাটি গ্রহণযোগ্য হতো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিভিল সোসাইটি খুব একটা কার্যকর নয়, বিরোধী দলও প্রভাবশালী নয়। সেক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা আছে।

চক্রবর্তী বলেন, এ ধরণের পরিস্থিতিতে যত উন্নয়নই হোক না কেন সেটা টেকসই হবার ক্ষেত্রে প্রশ্ন তৈরি হয়।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা এবং নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে।

২০২১ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্রের সূচকে ”হাইব্রিড রেজিম” বা মিশ্র শাসনের দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

সাধারণত সেইসব দেশকে হাইব্রিড রেজিম বলে বর্ণনা করা হয় যেসব দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে, কিন্তু সেখানে নিয়মিত নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক দমন-পীড়নও চলে।

অর্থাৎ এসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরণের প্রতিবেদনকে বাংলাদেশ সরকার সবসময় খারিজ করে দেয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছিল দলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন নূহ-উল-আলম লেলিন। তিনি বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রকে উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে হিসেবে বিবেচনা করেনি।

“আওয়ামী লীগের কোন দলিলে কিন্তু বলা হয়নি যে আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র,” বলেন মি. লেলিন।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে ছিল মানুষের খাদ্য, কর্মসংস্থান এবং বাসস্থানসহ নানাবিধ সুবিধা নিশ্চিত করা।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, মানুষের বাসস্থান, খাদ্য এবং কর্মস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টি কি গণতন্ত্র নয়?

অনেকে মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া না থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকে উদাহরণ দেন চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া অথবা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে।

আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের নজিরও রয়েছে অজস্র।

আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমসের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, যেসব দেশে সরকারগুলোর বৈধতার সংকট থাকে তারা উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে।

“যেসব দেশ গণতান্ত্রিক সেখানে উন্নয়নের বিষয়টিকে এতো জোর দিয়ে সামনে আনা হয় না।,” বলেন মি. আহমেদ।

চীনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র কোন ফ্যাক্টর নয়।

“কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরণের উন্নয়ন ডিসায়ারেবল (কাঙ্ক্ষিত) কি না? এখানে জনগণের অংশগ্রহণ আছে কি না? এ বিতর্ক কিন্তু রয়ে গেছে,” বলেন মি. আহমেদ।

তিনি বলেন, আমরা কোন ধরণের মডেল চাই সে বিতর্ক রয়ে গেছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে বেশ কিছু বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরতে পেরেছে।

তবে একইসাথে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে, যা নিয়ে সরকার নানা সময় সমালোচনার মুখে পড়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা অবশ্য মনে করেন, তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা তাদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন এবং এই ধারণা থেকে সরে আসার কোন কারণ আছে বলেও তারা মনে করেন ন।

এসএইচ-০২/১৫/২২ (আকবর হোসেন, বিবিসি)