সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসীদের ভিড়

মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচির আওতায় দেশে ফিরছেন বাংলাদেশি অবৈধ প্রবাসীরা। দেশে ফিরতে প্রতিদিন মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে টাভেল পাস নিতে ভিড় করছেন তারা।

এদিকে দূতাবাসে ট্রাভেল পারমিট (টিপি) ইস্যুতে কঠোর নজরদারির পরও থেমে নেই দালালদের দৌরাত্ম্য। কাউকে ট্রাভেল পাসের জন্য অর্থ দিয়ে থাকলে এবং প্রতারিত হলে তথ্য ও প্রমাণাদিসহ মিশনে যোগাযোগ করতে বলা হলেও যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ট্রাভেল পারমিট করে দেয়ার নামে দালালি অফিস। ওইসব অফিস ফেসবুক আইডি খুলে ট্রাভেল পারমিট করে দেয়ার নামে সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার রিঙ্গিত। ফলে অবৈধ বাংলাদেশিরা ট্রাভেল পাস পেতে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার বলেন, দালাল বা প্রতারকদের সঙ্গে লেনদেন না করতে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছে।

হাইকমিশনার বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষিত এ কর্মসূচির আওতায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কোনো তথ্য নেই বা ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করেছে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছে এমন ব্যক্তিরা সহজ শর্তে মালয়েশিয়া ত্যাগের সুযোগ পাবেন।

এ কর্মসূচি ১ আগস্ট শুরু হয়েছে চালু থাকবে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট বা ট্রাভেল ডকুমেন্ট এবং নিশ্চিত (কনফার্মড) বিমান টিকিটসহ আবেদন করতে হবে এবং জরিমানা ও স্পেশাল পাস বাবদ সর্বসাকুল্যে ৭০০ রিংগিত জমা দিতে হবে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আবেদনের এক কার্যদিবসের মধ্যেই স্পেশাল পাস বা বহির্গমনের অনুমতি প্রদান করবে। এই অনুমতি প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই মালয়েশিয়া ত্যাগ করতে হবে। আবেদনকারীদের সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন সারাদেশে ৮০টির বেশি বুথ স্থাপন করেছে।

এ কর্মসূচির কাজ প্রক্রিয়াকরণের জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ বা ভেন্ডর বা এজেন্ট নিযুক্ত করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশন ইচ্ছুক অবৈধ প্রবাসীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানিমুক্ত সহজ পদ্ধতি প্রবর্তন এবং জেল জরিমানা ব্যতিরেকে দেশে ফেরা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে আসছিল। ফলে মালয়েশিয়া সরকার ‘বিফোরজি’ কর্মসূচি চালু করেছে।

কেননা বিদ্যমান পদ্ধতিতে গ্রেফতার, জরিমানা ও কারাবরণ শেষে ডিপোর্টেশন ক্যাম্পে অবস্থানের পর দেশে ফেরত যেতে হয়; আত্মসমর্পণকারীদের স্পেশাল পাস বা বহির্গমন অনুমতি পেতে ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হয় এবং ৩১০০ রিংগিত বা তার বেশি জরিমানা দিতে হয়, যা তাদের জন্য কষ্টকর।

প্রতিদিন মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকরা ট্রাভেল পাস নিতে ভোর বেলা থেকেই বাংলাদেশ হাইকমিশনে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। ১ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হয়েছে।

এদিকে ট্রাভেল পাস নিতে বাংলাদেশিরা যাতে হয়রানির শিকার না হন সেজন্য মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফেসবুক পেজে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এদিকে প্রতারণা থেকে সাবধান হতে এবং যেকোনো এজেন্ট বা ভেন্ডরের সঙ্গে টাকা লেনদেন না করার জন্য মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে নোটিশ জারি করা হয়েছে।

দূতাবাসের নোটিশে বলা হয়েছে, ট্রাভেল পারমিট এবং স্পেশাল পাস সম্পূর্ণ আলাদা। স্পেশাল পাস দেয় মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন। ট্রাভেল পারমিট (টিপি) দেয় বাংলাদেশ হাইকমিশন। ট্রাভেল পারমিট সম্পর্কে তথ্য নিম্নে দেয়া হলো-

ট্রাভেল পারমিট
এটি মূল পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে সাময়িক ব্যবস্থা। এটির মেয়াদ ৯০ দিন। বিদেশ ভ্রমণকারীকে বা অবস্থানকারীকে শুধু দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য জরুরি হিসেবে দেয়া হয়। ট্রাভেল পারমিট দেয়ার আগে পাসপোর্টের মতোই সব তথ্য যাচাই করে দেয়ার বিধান রয়েছে। প্রবাসে এটি দেয়ার একমাত্র কর্তৃপক্ষ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন।

ট্রাভেল পারমিট পাওয়ার শর্ত:
যাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট আছে কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়েছে, হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়েছে তাদের জন্য ট্রাভেল পারমিট পাওয়া সহজ। আবেদনের সঙ্গে পুরনো বা হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হওয়া পাসপোর্টের তথ্য দিতে হবে। পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই পুলিশ রিপোর্ট করে আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে। এটাই প্রমাণ যে পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। তাহলে একদিনেই ট্রাভেল পারমিট (টিপি) পাওয়া যাবে।

আর যাদের কখনোই পাসপোর্ট ছিল না তাদের সময় লাগবে। কারণ তাদের নাগরিকত্ব বাংলাদেশ থেকে যাচাই করে নিতে হয়। এজন্য সময় লাগে। নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হয়ে টিপি দেয়া আইনত নিষেধ।

ভুল বা মিথ্যা তথ্য বা কাগজ জমা দেয়ার কারণে টিপি পাওয়া যাবে না।

নিয়ম:
নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদন ফরমের সঙ্গে ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি, পাসপোর্টের ফটোকপি (যদি থাকে), ভিসার ফটোকপি (যদি থাকে), আইডি কার্ডের ফটোকপি (যদি থাকে), মাইইজি/ইমান/বিএম এর কাগজ অর্থাৎ যেকোনো একটি প্রমাণ হিসেবে জমা দিতে হবে। ভিসা ও আইকাডে এবং ইমান/মাইইজি/বিএম কাগজে পাসপোর্ট নম্বর লেখা থাকে যা দেখে নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়।

আর যাদের পাসপোর্ট নেই তাদের নিজ উপজেলার ইউএনও বা জেলা প্রশাসকের পত্র সঙ্গে দিতে হবে। এটি যার পাসপোর্ট নাই তার নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়ার উপায়। দ্রুত করার জন্য প্রত্যাশীর পরিবার থেকে ইউএনও অফিসে আবেদন করতে হবে। ইউএনও যাচাই করে নাগরিকত্ব তথ্য হাইকমিশনে ই-মেইলে [email protected] প্রেরণ করবে। ফলে হাইকমিশন টিপি দিতে পারবে। নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হয়ে টিপি দেয়া যাবে না।

ফি : ৪৪ রিংগিতের (জগ ৪৪) ব্যাংক ড্রাফট (হলুদ রঙের) Maybank অ্যাকাউন্ট নম্বর ৫৬৪৪২৭১০২২৬৮ যেকোনো শাখায় কাউন্টারে জমা দিয়ে হলুদ স্লিপ নিতে হবে। এই হলুদ স্লিপ আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে। ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার এবং নগদ অর্থ গ্রহণ করা হবে না।

আবেদন করার ঠিকানা:

পাসপোর্ট সার্ভিস কেন্দ্র, ১৬৬ জালান বেসার, আমপাং (আমপাং এলআরটির পাশে), কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া (166 Jalan Besar Ampang, Kuala Lumpur, Malaysia)|।

অর্থাৎ আবেদনের সঙ্গে দিতে হবে-৩ কপি রঙিন ছবি, পাসপোর্ট বা ভিসার ফটোকপি, ফি জমার হলুদ ব্যাংক স্লিপ। পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে পুলিশ রিপোর্ট। যাদের পাসপোর্ট ছিল না তাদের নাগরিকত্বের সমর্থনে ইউএনও বা জেলা প্রশাসকের পত্র।

জমা দেওয়ার সময় : সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। বিতরণ: বিকেল ৪-৫ টায় নিজে উপস্থিত হয়ে টিপির আবেদন জমা দিতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে। পাসপোর্টের মেয়াদ থাকলে এবং কাছে থাকলে টিপি লাগবে না।

যোগাযোগ নম্বর- টিপি সম্পর্কিত তথ্যের জন্য ফোন +৬০১০২৪৯৭৬৫৭; +৬০১২৪৩১৩১৫০; +৬০১২২৯৪১৬১৭; +৬০১২২৯০৩২৫২।

সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে থাকা বিদেশি শ্রমিকদের বৈধ করতে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রি-হায়ারিং প্রকল্প হাতে নেয় দেশটি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিবন্ধন করে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। দফায় দফায় এ প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয়। তবে অনেক অবৈধ বাংলাদেশি প্রতারিত হয়ে এ প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারেননি। যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই-এমন অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দিতেই রি-হায়ারিং প্রকল্প গ্রহণ করে দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ায় রি-হায়ারিং প্রকল্প প্রায় আড়াই বছর ধরে চলে।

মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক খায়রুল দাজাইমি আবু দাউদ জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এখান থেকে সব অবৈধ অভিবাসীকে বিফোরজি পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। যারা ওই তারিখের মধ্যে দেশে ফিরবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের নিরাপত্তা রক্ষার তাগিদে কোনো পক্ষের সঙ্গে আপসে যাবে না প্রশাসন।

দূতাবাসের শ্রম শাখার প্রথম সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল এ প্রতিবেদককে বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষিত এ কর্মসূচির আওতায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কোনো তথ্য নেই বা ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করেছে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছে এমন ব্যক্তিরা সহজ শর্তে মালয়েশিয়া ত্যাগের সুযোগ পাবেন।

দূতাবাস থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টি ট্রাভেল পাসের জন্য আবেদন জমা পড়ছে। ১ আগষ্ট থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দেড় হাজার ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হয়েছে। তবে ট্রাভেল পাশ ইস্যুর ক্ষেত্রে আবেদনকারীর তথ্যাদি যাচাই বাচাই পূর্বক ট্রাভেল পাশ ইস্যু করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি তথ্য গোপন রাখে অথবা তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হবে না।

এ কর্মসূচির কাজ প্রক্রিয়াকরণের জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ বা ভেন্ডর বা এজেন্ট নিযুক্ত করা হয়নি। কোনো মাধ্যম ছাড়াই আবেদনকারীকে সরাসরি নিকটস্থ ইমিগ্রেশন অফিসে হাজির হতে হবে।

যদি কেউ তৃতীয় পক্ষ বা ভেন্ডর বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রদান করে আর সেটি প্রমাণিত হয় তাহলে আবেদনকারীর জেলজরিমানা হতে পারে।

এসএইচ-০৫/২২/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)