শিশু সুমাইয়ার এক পায়ের জীবন সংগ্রাম

অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এক পায়ের ওপর ভর করে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দুরে সুমাইয়া প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। শুধু তাই নয় সুমাইয়া খেলাধুলাও করে ওই এক পায়ে ভর দিয়েই। তার বয়স মাত্র ১০ বছর। শিশু সুমাইয়া উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের আলীপাড়ার রিকশাচালক শফিকুল ইসলামের মেয়ে। সুমাইয়ার স্বপ্ন বড় হয়ে সে চিকিৎসক হবে।

এর মধ্যেই জীবন বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার স্কুলছাত্রী সুমাইয়ার। ২০১৬ সালে মাত্র দুই বছর বয়সে রাস্তায় পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় তার বাম পা বিকল হয়ে যায়। সুমাইয়া বড় হতে থাকে। কিন্তু পা আর সোজা হয় না। সেও এক পায়ে হাঁটার অভ্যাস শুরু করে।

একদিন জনৈক প্রতিবেশীর পরামর্শক্রমে স্থানীয় কবিরাজের নিকট তাকে নিয়ে যায় তার পরিবার। কবিরাজ ওষুধ দিয়ে বলে, এ ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সুমাইয়ার পা আর ঠিক হয় না। বাঁকা পা নিয়েই বড় হতে থাকে সে। তার দুর্ঘটনায় বেঁকে যায় পা এখন ডান পায়ের থেকে ছোট হয়ে গেছে। তাই লাফিয়ে লাফিয়ে সব কাজ করতে হয় তাকে।

কিন্তু সে ‘প্রতিবন্ধী’ তকমা নিয়ে থেমে যেতে রাজি নয়। তার বয়স যখন ৫ বছর, তখন তার বাবা-মা তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেও পড়াশোনা শুরু করে। তাকে আসা-যাওয়া মিলিয়ে অন্তত দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সুমাইয়া উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের উত্তর আলোকডিহি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

সুমাইয়া পিঠে ব্যাগ নিয়ে অন্তত এক কিলোমিটার রাস্তা এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ব্যাগ রেখে আবার এক পায়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এসে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলায় যোগ দেয়। খেলার সময়ও তাকে লাফাতে হয়। শুধু মাটিতে বসলেই তার বাঁ পা মাটিতে স্পর্শ করে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বা হাঁটার সময় কোনোভাবেই মাটিতে পা পড়ে না। কোনো দিকে যেতে বা অগ্রসর হতে হলে তাকে ডান পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে যেতে হয়। এভাবেই সব কাজ করতে হয় সুমাইয়াকে।

সুমাইয়ার মা সুমি আক্তার বলেন, আমার মেয়ে ছোটবেলায় সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। মেয়ের এভাবে চলার দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারি না। দু’চোখে পানি আসে। আল্লাহ যদি আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিতেন! সবার মতো স্বাভাবিক দুই পা দিয়ে হেঁটে চলাফেরা করতে পারে।

সুমাইয়ার পিতা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রিকশা চালাই। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। অভাবের সংসার। তাই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। বাড়িতে থাকতে পারলে মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, এই আট বছরে মেয়ের অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। মেয়ের এভাবে স্কুলে যাওয়া-আসার কষ্ট দেখে আমি বাবা হিসেবে সইতে পারি না। মাস দেড়েক আগে মেয়েকে দিনাজপুর মেডিকেলে নিয়ে যাই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, সুমাইয়ার পায়ে অস্ত্রোপচার করলে পা ঠিক হয়ে যাবে। এজন্য প্রয়োজন ৩ লাখ টাকা। কিন্তু আমার পক্ষে রিকশা চালিয়ে এই খরচ বহন করা সম্ভব না। তাই তিনি সুমাইয়ার চিকিৎসার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।

উত্তর আলোকডিহি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামনুর রশিদ বলেন, সুমাইয়ার ইচ্ছাশক্তি আমাদের অভিভূত করেছে। চিকিৎসার অভাবে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। পড়াশোনার প্রতি ১০ বছরের সুমাইয়ার ভালোবাসা আমাদের আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। সে পড়াশোনায় ভালো। সে আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা। চিকিৎসার অভাবে তার চলার পথ যেন বন্ধুর না হয়। সবাইকে সুমাইয়ার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার এমজিএম সারোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি কেউ প্রথমে জানায়নি। জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটি হুইলচেয়ার কিনে দিয়েছি ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সব দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছি। তার দিকে প্রতিদিন বিশেষ নজর দেয়া হবে শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে।

সোমবার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, স্কুলছাত্রী সুমাইয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়টি আমি জেনেছি। মঙ্গলবার আমার অফিসে তাদের ডেকেছি। আসলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসএইচ-০৪/২৩/২২ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)