করোনায় মা-বাবা হারিয়ে চিকিৎসা পেশা ছাড়ার ঘোষণা এক ডক্টরের!

জি. এম. মুরতুজা: “আমি চিকিৎসা পেশায় থাকতে চাই না। যে পেশায় থেকে আমার বাবা-মা’কে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। সেই পেশায় আর নয়”। ফেসবুকে এমন আবেগময় স্ট্যাটাস দিয়ে চিকিৎসা পেশা ছাড়াও ঘোষণা দিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক ডা. জাকি উদ্দিন। তিনি শুরু থেকে এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা না থাকায় কুমিল্লার রেসকোর্সের বাসা থেকে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতেন তিনি। ছয় মাসে আগে তিনি, তার ছোট বোন ও বাবা-মা সবাই করোনায় আক্রান্ত হোন। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের চার জনকেই ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। ওইখানে মারা যান তার মা জাহানারা নাসরিন। করোনা থেকে সুস্থ হলেও বাবা সালাউদ্দিনের নানা বিরুপ উপসর্গ দেখা দেয় এবং তিনি প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত তার বাবা আর ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বুধবার রাতে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করান ডা. জাকি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর মারা যান তার বাবা।

মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে করোনায় মা এবং বাবাকে হারিয়ে নিজের পেশার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন সম্ভাবনাময় এই চিকিৎসক ডা. জাকি উদ্দিন। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, “কোভিড রোস্টারে নাইট ডিউটিতে ছিলাম। আব্বুর অবস্থা খারাপ শুনে আমি ডিউটি থেকে গিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। কিন্তু আটকাতে পারলাম না। জ্ঞান থাকা অবস্থায় বলেছিল, বড় বাবু ব্যবস্থা করবে। আমি আব্বু-আম্মুর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। একদম এতিম হয়ে গেছি ছয় মাসের ভেতর। কোভিড দিয়ে ইনফেকটেড করে মেরে ফেলেছি। কোন পিতা-মাতা আমার মত সন্তান প্রত্যাশা করেন না, যে তাদের ছয় মাসের মধ্যে হত্যা করেছে। নো প্যারেন্টস ডিজার্ভ অ্যা চাইল্ড লাইক মি, হু কিলস দেয়ার প্যারেন্টস উইদইন সিক্স মানথস। আই থিঙ্ক আই শেল নট কন্টিনিউ দিজ প্রফেশন এনিমোর।’

ডা. জাকি উদ্দিন ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দিয়ে চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণার প্রেক্ষিতে, বিএমএ কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক ডা. আতাউর রহমান জসিম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কী বলব, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ছয় মাসের ব্যবধানে তরুণ ডাক্তারটি মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেল। তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে দায়িত্বরতদের জন্য কোয়ারেন্টিন বা আবাসিক ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করছেন। কত টাকা এই দেশে অপচয় হয়। পুকুর কাটা, খিচুড়ি রান্না, কলাগাছ লাগানোসহ প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ, কেনাকাটার লাগামহীন আকাশচুম্বী দাম, নাম না জানা ও নামসর্বস্ব প্রজেক্ট, কত খাতেই তো অর্থ অপচয় হয়। ডাক্তারদের জন্য কি উন্নত ব্যবস্থাপনা করা যায় না?’

বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিয়ে নানা সমালোচনা থাকতে পারে। তাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু দেশে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে চিকিৎসকরা যেভাবে করোনা রুগীদের সামনে থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। দেশের এই মহাবিপর্যয়ের সময় তারাই আসলে সত্যিকার নায়ক, প্রকৃত যোদ্ধা। কিন্তু এই সম্মুখ যোদ্ধাদেরই যদি করোনা রুগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য প্রণোদনা ও অনুপ্রেরণা না দেয়া হয়, উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় এনে তাদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা না করা হয়, তবে ডা. জাকি উদ্দিন-এর মত অনেক চিকিৎসক এই সম্মুখযুদ্ধ থেকে ইস্তেফা দিতে উদ্বুদ্ধ হবেন। দেশের এই মহাক্রান্তিকালে আমরা চাই না ডা. জাকি উদ্দিন-এর মত প্রকৃত নায়ক ও যোদ্ধারা পিছু হঠে যাক মনোকষ্টে কিংবা মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে। এই মহাযুদ্ধে জিততে হলে আমাদের সকল সম্মুখ যোদ্ধাদের সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই উপযুক্ত প্রণোদনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। নতুবা এই মহাযুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে, মানুষের মৃত্যুর মিছিলও বাড়তে থাকবে। আমরা হারাতে থাকবো আপনজনদের। এটা মোটেই কামনা করি না।