ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা

১৯৬৬ সাল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ৮ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হচ্ছে সবকিছুর। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে তাই প্রয়োজন নতুন করে সাক্ষরতার ধরনে বিশদ পরিবর্তন আনা। তার আগে জেনে নেওয়া যাক সাক্ষরতা বলতে কি বোঝায়?

সাক্ষরতা হল শেখার বা লেখার যান্ত্রিক ক্ষমতা বা দক্ষতা, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যেকোনো ভাষা বা সিস্টেমে পড়তে এবং লিখতে পারে এবং সামগ্রিক সামাজিক কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।

সাক্ষরতা একটি মৌলিক মানব দক্ষতা যা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষরতা ব্যতীত, একজন ব্যক্তি কোন ধরনের লেখা পড়তে অক্ষম এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত উন্নতি করতে অক্ষম। সময়ের সাথে সাক্ষরতার ধারণায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। নানান সংযোজন বিয়োজনের মধ্য দিয়ে সাক্ষরতার পরিধির বিস্তার ঘটেছে বহুলাংশে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে ইউনেসকো সাক্ষরতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে। বর্তমানের সংজ্ঞায় সাক্ষরতার সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষা দক্ষতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা সংযোজিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে বলা যায়, স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণের জন্য , রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সামাজিক যোগাযোগে আচরণে এবং কর্মের নির্দেশক হলো সাক্ষরতা।

পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সাক্ষরতার সাথে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সাক্ষরতার ধারনাটি। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ দেশ কালের গন্ডি অতিক্রম করে ফেলেছে,গোটা পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। আমরা প্রত্যেকেই এখন গ্লোবাল ভিলেজের অধিবাসী , পুরো বিশ্ব একটা বৈশ্বিক গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে এখন সব কিছুই সবার কাছে দৃশ্যমান। তাই যুগের সাথে তাল মেলাতে গতানুগতিক সাক্ষরতার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ডিজিটাল সাক্ষরতার দিকে মনোনিবেশ করার সময় এসেছে। সাক্ষরতা বিষয়টি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাক্ষরতা দক্ষতাগুলো কাজে লাগাতে হবে । সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ধারণা থাকতে হবে।

কোন কোন বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া উচিত নয়, তা জানা; ছবি, ভিডিও ও কনটেন্ট সম্পর্কে মানসম্মত ধারণাগুলো ডিজিটাল সাক্ষরতার অন্তর্ভুক্ত।ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনতে মানুষের ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনে কাজ করার পাশাপাশি অনলাইন শিষ্টাচার, সাইবার ওয়েলনেস, নিরাপত্তা, তথ্য সাক্ষরতা, গণমাধ্যমে সাক্ষরতা, জ্ঞান ভাগ ও বিতরণ করা সহ সংশ্লিষ্ট সচেতনতা গড়ে তোলাই ডিজিটাল সাক্ষরতার মূল লক্ষ্য।

ডিজিটাল সাক্ষরতা মূলত ৫ প্রকার। ডিজিটাল সাক্ষরতার মধ্যে রয়েছে

• ডেটা সাক্ষরতা: ডেটা সাক্ষরতা হল ডেটা পড়ার, বোঝার, বিশ্লেষণ করার এবং কার্যকরভাবে ডেটার সাহায্যে যোগাযোগ করার ক্ষমতা

• তথ্য সাক্ষরতা: তথ্য সাক্ষরতা হলো তথ্য অনুধাবন, বিশ্লেষণ, এবং ব্যবহারের দক্ষতা। এটি বিশেষভাবে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রস্তুতিকরণ, তথ্য প্রচার এবং তথ্য বিশ্লেষণের দক্ষতা।

• ভিজ্যুয়াল সাক্ষরতা: ভিজ্যুয়াল সাক্ষরতার মৌলিক সংজ্ঞা হল ভিজ্যুয়াল ইমেজ বোঝা এবং তৈরি করার ক্ষমতা। এটি একটি ধারণা যা শিল্প এবং নকশার সাথে সম্পর্কিত তবে এর অনেক বিস্তৃত প্রয়োগ রয়েছে। ভিজ্যুয়াল সাক্ষরতা মূলত ভাষা, যোগাযোগ এবং মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কিত ।

• মিডিয়া সাক্ষরতা : মিডিয়া সাক্ষরতা হ’ল সাক্ষরতার একটি বর্ধিত ধারণা যার মধ্যে রয়েছে মিডিয়া বার্তাগুলি অ্যাক্সেস এবং বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি তৈরি, প্রতিফলিত এবং পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা, তথ্য এবং যোগাযোগের শক্তি ব্যবহার করে বিশ্বে একটি দৃশ্যমান পার্থক্য তৈরি করা।

• ধাতববিদ্যা : প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ডিভাইস এবং অ্যাপ্লিকেশন গুলোর ব্যবহার সম্পর্কিত দক্ষতা অর্জন।

সেইসাথে আমাদের ডিজিটাল বিশ্বে সামাজিক এবং নৈতিক সমস্যাগুলি মূল্যায়নের জন্য সম্পর্কিত ক্ষমতা।ডিজিটাল বিশ্বে মিডিয়া এবং তথ্যের উপচে পড়া প্রাচুর্যের কারণে, ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। এটি ব্যবহারকারীদের তাদের গোপনীয়তা যাচাই করতে, ডিজিটাল ডেটা এবং তথ্য বিশ্লেষণ করতে, নৈতিকভাবে ব্যবহার করতে এবং অন্যদের সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে।

ডিজিটাল সাক্ষরতার চারটি মূলনীতি রয়েছে যথা:

১.বোধগম্যতা: এই নীতিটি ডিজিটাল বিষয়বস্তু বোঝার ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২.আন্তঃনির্ভরতা: ডিজিটাল সাক্ষরতা বিকাশের একটি মূল উপাদান হল কীভাবে সমস্ত মিডিয়া ফর্ম পরস্পর সংযুক্ত এবং ব্যবহারকারীরা কীভাবে আরও সহজে সামগ্রী ব্যবহার করতে পারে তা বোঝা।

৩.সামাজিক কারণ: বয়স, শিক্ষা, লিঙ্গ, আয় এবং পরিবারের ধরনগুলি কীভাবে নির্দিষ্ট মিডিয়াকে অনুভূত হয় বা কোন বিষয়বস্তু বেশি সফল তা বুঝতে সাহায্য করে। সুতরাং, এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে মিডিয়া বা বিষয়বস্তু তৈরি, ভাগাভাগি ও সংরক্ষণ এবং এর দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের একটি জৈব ইকোসিস্টেম তৈরিতে এই কারণগুলি বিশাল ভূমিকা পালন করে।

৪. কিউরেশন: এই নীতি ব্যবহারকারীদের তাদের পছন্দ অনুযায়ী ডিজিটাল সামগ্রী খুঁজে, সংগঠিত এবং সঞ্চয় করার অনুমতি দেয়।

ডিজিটাল সাক্ষরতা একটা সামাজিক আন্দোলন। ডিজিটাল সাক্ষরতা হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। আগামীর কথা মাথায় রেখে যারা ডিজিটাল সাক্ষরতার সুযোগের বাইরে আছে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে শেখাতে হবে ডিজিটাল সাক্ষরতা।এটা মাথায় রাখতে হবে প্রতিটি মানুষের শেখার ধরন আলাদা আলাদা, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সাক্ষরতা অর্জনে সবাইকে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সাক্ষরতা অর্জনের পদ্ধতিগুলো মানসম্মত ও ন্যায়সংগত হতে হবে। ডিজিটাল সাক্ষরতার ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মিডিয়া শিখতে, শেয়ার করতে এবং সংগঠিত করার নিজেদের ক্ষমতার বিকাশ আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন জগত খুলে দেয়।

কিছু সহজ টিপস যা আমাদেরকে ডিজিটাল সাক্ষরতার দক্ষতা বিকাশ এবং বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে:

• ডিজিটাল টুল দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করা।
• নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে আপ টু ডেট থাকা।
• প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিতে ফোকাস থাকা।
• জীবনব্যাপী শিক্ষার মানসিকতা গ্রহণ করা।
• বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সেগুলি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি করা।
• নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করার সময় সাহায্যের জন্য জিজ্ঞাসা করা ।

ডিজিটাল সাক্ষরতা আজকের ডিজিটাল বিশ্বে কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাই আমাদের উচিত সকল বয়সের জন্য ডিজিটাল দক্ষতা শেখানো এবং শেখানোকে উৎসাহিত করা। এর মাধ্যমে আমরা জীবনব্যাপী নিজেদের দক্ষতা বিকাশ করতে পারবো তার মানে আমরা চিন্তাভাবনা এবং দায়িত্বের সাথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করবো, বিভিন্ন মিডিয়া এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে দক্ষতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হবো এবং নিজেদের ডিজিটাল পদচিহ্ন একটি ইতিবাচক পদ্ধতিতে পরিচালনা করতে সক্ষম হবো। এর মাধ্যমে আমরা শুধু ব্যক্তিজীবনে নয় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সুতরাং, আমরা এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে ডিজিটাল সাক্ষরতা শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, সমাজেরও উপকার করে, কারণ ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা দেশগুলির অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার বিকাশে সহায়তা করে।

এআর-০২/১১/০২ (মারিয়া বিনতে মতিন)