স্কুলে যাওয়ার অপেক্ষায় তারা

একটা সময় ছিল, স্কুল থেকে ফিরেই খেলার মাঠ। কি শহর, কি গ্রাম, সবত্রই ছিল উল্লাস, হৈ চৈ। শুভ্র উচ্ছ্বাস। কাঁধে ঝোলানো বইয়ের ব্যাগটি পাশে রেখে একটু খেলাধুলা শেষ করে বাসায় গিয়ে মা-বাবার বকুনি খাওয়ার গল্পও আছে অসংখ্য। সেই শিশু পৃথিবীকে যে চোখে দেখেছে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের সেই উদ্দামতা, সেই কোলাহল।

এর পাশাপাশি পড়াশোনা, ক্লাস-পরীক্ষার সঙ্গে বাড়ির পড়ার টেবিলের রুটিন একেবারে কাছাকাছি হলেও। করোনায় সেই রুটিনও তছনছ করে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি যত বেড়েছে, ততটাই দূরত্ব বেড়েছে বই থেকে শিক্ষার্থীদের। স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই, পরীক্ষা নেই তাই পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ওরা।

পাড়া-মহল্লায় হৈহুল্লোড়, আড্ডা, খেলাধুলা, মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার আর টেলিভিশনের স্ক্রিনে চোখ রেখে সময় পার করছে। শুধু তা-ই নয়, ওদের দৈনন্দিন রুটিনও বদলে গেছে। এমন বাস্তবতায় সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকরা। অষ্টম থেকে

দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে আলাপকালে তাদের বদলে যাওয়া সময়ের থেমে যাওয়া গল্পের নানা বিষয় জানা গেল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ছকে বাঁধা জীবনের ছন্দপতনের কারণে তাদের মধ্যে লেখাপড়ায় গাছাড়া ভাব এসেছে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার বাইরে চলে যাচ্ছে। যে করেই হোক, তাদের স্বাভাবিক রুটিনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

অভিভাবকদের সচেতনতার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আরিফা রহমান বলেন, অন্য যে কোনো ছুটির তুলনায় এবারের ছুটি ভিন্ন। আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, কোচিংয়ে যাওয়া, বাসায় টিউটরদের কাছে লেখাপড়া করা- এমন একটা ছকের মধ্যে চলার অভ্যাস। এসব থেকে একটু বেরোতে পারলে শিক্ষার্থীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এর মধ্য দিয়ে তাদের মানসিক একটা প্রশান্তি কাজ করে। ওদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে স্বাভাবিক রুটিনে রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

স্কুল বন্ধ। প্রতিদিন কীভাবে সময় কাটছে- এমন প্রশ্নে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার বেগম আয়েশা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবিহা জান্নান বলে, ‘স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই, এ জন্য পড়ার প্রতি তার আগ্রহ কম।

সে জানায়, কতবার শুনছি স্কুল খুলবে তার কোনো খবর নেই। তার মা সাহিদা বেগম জানান, আগে স্কুল খোলা থাকলে নিয়মিত পড়াশোনা হতো, এখন বাসায় একেবারেই পড়াশোনা করছে না তার মেয়ে। তাবিহার এক ভাই স্থানীয় মইতপড়া দাখিল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। মাদ্রাসা বসে না, সারাদিন ঘুরে বেড়ায় সে। তাবিহা কিংবা তার মতো নগর-বন্দর-শহর কিংবা গ্রামে লাখ লাখ শিক্ষার্থী এক অবসর সময় পার করছে।

ঢাকার মগবাজার হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী হুমায়ারার সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, পড়ার টেবিলে বসা হয় কম। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী সে। কিন্তু পরীক্ষা হবে কি হবে না- এমন দোটানায় পড়ে কোনো কিছুতেই মন বসে না তার।

একসময়ে টেলিভিশনের ক্লাসে মনোযোগ থাকলেও এখন নেই জানিয়ে ধামরাই উপজেলার হর্ডিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী খুকু মণি বলে, ‘অ্যাসাইনমেন্টগুলো সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলে জমা দিতে যায়। তার বাবা সামছুদ্দিন মাসউদ অভিযোগ করেন, সারাক্ষণ টেলিভিশন দেখা আর ঘুম ছাড়া কোনো কাজ নেই। এমনকি খাবারের প্রতিও উদাসীন তার সন্তান।’

ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত গাজীপুরের রানীবিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুবর্ণের বড় বোন সিমলার। তিনি বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধে সারাদিন এখন পাড়ার বড়ভাই-ছোটভাইদের সঙ্গে সময় কাটায়। পাড়ায় ভালো-মন্দ সব ধরনের ছেলে আছে। তাদের সংস্পর্শে একদমই কথা শোনে না।’

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ছেলেমেয়েদের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়ে নরসিংদী সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক জানান, ‘তার মেয়ের নাচ শেখার আগ্রহ ছিল, বাসায় এখন আর চর্চা করে না। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া দরকার।’

কিশোরগঞ্জ সদরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নবনিতা জানায়, করোনার আগে গানের স্কুলে গান শেখা হতো, গৃহশিক্ষক ছিল, করোনার সময় শিক্ষক নেই। যতটুকু শেখা হয়েছিল সব ভুলে গেছে।’

ছুটিকালীন লেখাপড়া প্রসঙ্গে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবেক অধ্যক্ষ ফৌজিয়া বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ এটি যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে বেদনাদায়ক, আবার তাকে এ সময়ে নতুন করে তৈরি করারও সুযোগ হয়েছে। কারণ এ সময় তাদের কোনো নিয়মিত ছকে বাঁধা পাঠ্য বিষয়, প্রশ্ন-উত্তর, বিজ্ঞান, গণিতের হোমওয়ার্ক নেই। পড়ার কোনো সময়সূচিও বাঁধাধরা নেই। এ স্বাধীনতাকে শিক্ষার্থীরা সঠিক কাজে লাগাতে পারলে পরীক্ষার ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে না অভিভাবকদের।

করোনার ছুটিতে বাসায় স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের চর্চা করার পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক আরিফা রহমান। তিনি বলেন, পারিবারিক বন্ধনে ছেলেমেয়েদের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে লেখাপড়ায় ছেলেমেয়েদের আগ্রহ তৈরি হবে।

দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এসএইচ-০৭/০২/২১ (শিক্ষা ডেস্ক)