শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা কমছে না!

করোনার সময়ে ১৫ মাসে বাংলাদেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এই প্রবণতা কমছে না বলে মনে করছে এনিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান।

মনোবিশ্লেষকেরা বলছেন,, এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিতে হবে।

তরুণদের দিয়ে পরিচালিত একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা হলেও বাস্তবে তা আরো বেশি হতে পারে। সংগঠনটির প্রধান তানসেন রোজ জানান, গত মার্চ মাসে তারা আরেকটি জরিপ প্রকাশ করেছিলেন।

তাতে দেখা গেছে করোনার এক বছরে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে তরুণ-তরুণী। ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে তাদের বয়স। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা দেখেছেন, অনিশ্চয়তাই প্রধান কারণ। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হতাশায় আক্রান্ত হন। আর চাকরি চলে যাওয়াও অনেক তরুণের হতাশার কারণ।

তিনি জানান,”তরুণ শিক্ষার্থীরা এই সময়ে অনলাইনে ঝুঁকে পড়ে, বিশেষ করে ফেসবুক তারা বেশি সময় কাটায়। এটাও তাদের মধ্যে অবসাদ তৈরি করে। আর এই সময়ে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাবও পড়ে তাদের ওপর।”

যেসব শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী,২৯ জন মাদ্রাসার এবং ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেন৷

তানসেন বলেন,” আমরা নতুন আরেকটি জরিপ করেছি। এই মাসেই তা প্রকাশ করব। তাতেও আমরা দেখছি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে না। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। করোনার সময় শিক্ষার্থীরা ঠিকমত পড়াশুনা করতে পারেনি। পরীক্ষার চাপ আসছে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা দূর হচ্ছে না।”

সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে চুল কেটে দেয়া এবং তাদের মধ্যে একজনের আত্মহত্যার চেষ্টা এই সময়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তা বলে দেয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন,” এই সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পড়াশুনা বা পরীক্ষার চাপের চেয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এটা শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব তেমনি পরিবারের সদস্যদেরও দায়িত্ব।”

তিনি বলেন, সারাবিশ্বেই করোনার সময় মানসিক বিষন্নতাসহ মানসিক রোগ তিন থেকে পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। তাই সাধারণ স্বাস্থ্যের চেয়েও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশের এক লাখ ২৪ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একজন করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থাকা দরকার, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই যা নেই। তিনি বলেন,”তাই শিক্ষকদের সতর্ক থাকতে হবে। তাদের আনন্দের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। তাদের আচরণ হতে হবে শিক্ষার্থী বান্ধব। তাদের ওপর পড়া লেখা চাপিয়ে দেয়া যাবেনা। তাদের মনের যত্ন বেশি নিতে হবে।”

আর এখন একদিন নয় সপ্তাহে পাঁচদিনই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন,”যারা মারা গেছে তাদের তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু নতুন করে কেউ যাতে আত্মহত্যা না করে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনার সময় ঘরে বসে থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর এখনো যদি তারা একদিন স্কুলে যায় আর বাকি সময় ঘরে বসে থাকে তাহলে একই অবস্থা হবে।”

তার মতে,”সব দিন স্কুলে যাবে তবে অল্প সময় এক-দেড় ঘন্টা তারা স্কুলে থাকবে। পড়বে, খেলাধুলা করবে। বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। শিক্ষাকে আনন্দময় করতে হবে। আনন্দ মানে শুধু খেলাধুলা নয়। শিক্ষক ঠিক মতো পড়াতে পারলে তাও আনন্দময় হয়। তাই শিক্ষককে এখন হতে হবে অনেক বেশি দক্ষ। অভিভাবকদেরও তা জানতে হবে।”

এসএইচ-১৭/০৪/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)