ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের গ্রুপ চ্যাট কেলেঙ্কারি

সতর্কতা: এই খবরে এমন সব তথ্য রয়েছে, যা অনেক পাঠক পীড়াদায়ক বলে মনে করতে পারেন। একটি মেসেজ এ রকম, ফ্ল্যাটের সবাইকে ধর্ষণ কর। এতে তাদের একটা উচিত শিক্ষা হবে।

অ্যানা; যেটি তার আসল নাম নয়। ফেসবুকের গ্রুপ চ্যাটে তার বন্ধুদেরই লেখা এমন শত শত যৌন সহিংসতামূলক মেসেজ স্ক্রল করছিলেন। সেখানে তার এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য মেয়েদের নাম বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব আপত্তিকর মেসেজ যারা লিখেছে, তারা অ্যানারই সহপাঠী। ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিষয়ের শিক্ষার্থী সবাই। তারা শুধু অ্যানার সহপাঠীই নয়, বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুও।

অ্যানা যখন এসব মেসেজ দেখে ফেললেন, বিষয়টা আর গোপন থাকল না। যেটা ছিল নিছকই নিজেদের মধ্যে গোপন মেসেজ আদান-প্রদান, সেটা সবাই জেনে ফেলল। অ্যানা এবং তার আরেক মেয়ে সহপাঠী, যাদের নাম ওই মেসেজগুলোতে বারবার নেওয়া হয়েছে-তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তের পর দোষী প্রমাণিত হওয়ায় এক ছাত্রকে বরখাস্ত ও ক্যাম্পাসে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়। দু’জনকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ও বহিষ্কার করা হয়। আরো দুই ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

পরে ১০ বছরের জন্য বহিষ্কৃত দুই ছাত্রের সাজা কমিয়ে মাত্র ১২ মাস করা হয়। আর এতেই আলোচনার ঝড় ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যেভাবে ঘটনাটি তদন্ত করেছে তা নিয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন।

এক বছর পরেও এ ঘটনার রেশ কাটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে কী ঘটেছিল?

গত বছরের প্রথম দিকের ঘটনা। তখন অ্যানার বয়স ১৯ – একদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট রুমের সোফায় বসেছিলেন। তার পাশে থাকা বন্ধুর ল্যাপটপে হঠাৎ একের পর এক মেসেজ আসা শুরু হলো।

অ্যানা তার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কী? বন্ধুটি বলল, তোমার কাছে খারাপ মনে হতে পারে। তবে আমাদের ছেলেদের এই গ্রুপে আমরা মজা করে অনেক কথাই বলি। তুমি চাইলে দেখতে পার।

অ্যানা কৌতূহলী হয়ে দেড় বছর ধরে লেখা গ্রুপ মেসেজগুলো পড়তে শুরু করলেন। তখনই দেখলেন এগুলো নিছকই মশকরা করে লেখা মেসেজ না, রীতিমত ধর্ষণের হুমকি।

অ্যানা দেখলেন, ওই ফেসবুক চ্যাট গ্রুপে তার বন্ধুরা নিজেদের নাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার ও সিরিয়াল রেপিস্টদের নামে নিজেদের নাম রেখেছে।

তারা আমাদের এক সহপাঠীকে নিয়ে কথা বলছিল। লিখছিল কীভাবে তাকে অপহরণ করবে, তারপর শেকল দিয়ে বিছানায় বেঁধে রাখবে, ওকে বিছানায় প্রস্রাব করিয়ে তার ওপর ঘুমাতে বাধ্য করবে।

ওই গ্রুপে লেখা বেশিরভাগ মেসেজ ছিল এর চেয়েও ভয়াবহ। অ্যানা বললেন, এটা কোনো উটকো মন্তব্য নয়। একটা পুরো অনলাইন কমিউনিটি এ ধরনের কথা বলছে। তারা খুবই আনন্দের সাথে এ ধরনের ভয়াবহ কথা বলছে। এটা নিয়ে তারা বেশ গর্বিতও!

অ্যানা ওই চ্যাট গ্রুপে নিজের নাম সার্চ দিয়ে দেখলেন শত শতবার তাকে নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছে। অ্যানার বন্ধুটি বলল, এগুলো সবই মজা করে বলা। সিরিয়াস কিছু না। ছেলেরা এভাবেই কথা বলে। এগুলো নিছকই রসিকতা।

অ্যানা স্ক্রল করে চলেছিলেন। আর নিজের ফোনে ওদের এসব চ্যাটের ছবি তুলে রাখছিলেন। অ্যানা বলেন, আমি আমার বন্ধুকে বলেছিলাম যে এটা আমার মনের শান্তির জন্য করছি। কিন্তু আমার চেহারা দেখে আমার বন্ধুটি আঁচ করতে পেরেছিল যে ঘটনাটি আমি স্রেফ মজা হিসেবে নেইনি।

বিষয়টি অ্যানা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছে বুঝতে পেরে বন্ধুটি ভোল পাল্টে ফেলে। সে তখন তাকে বলল যে সে জানে ওই গ্রুপের কোনো কোনো মেসেজ খুবই আপত্তিকর। তাই অ্যানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত বলেই তাকে সে মেসেজগুলো দেখতে দিয়েছে।

মেসেজগুলো দ্রুত স্ক্রল করতে করতে অ্যানা যখন গণধর্ষণ, যৌনাঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে ডজন ডজন মেসেজ দেখেন, ভয়ে আঁতকে ওঠেন তিনি।

তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কী করা উচিত। কারণ যারা এমনসব ভয়াবহ কথা বলছে তারা সবাই আমার বন্ধু, আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এর কয়েকদিন পরেই ইস্টারের ছুটি কাটাতে তিনি বাড়িতে যান। কিন্তু ক্যাম্পাসে ফেরার পর আবার এই ছেলেদের সাথে তার দেখা হবে ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।

‘আমি ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য আমার জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম। কিন্তু ওখানে ফিরে যেতে আমার আর একটুও ইচ্ছা করছিল না।’ সেদিনই অ্যানা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্ত নেন।

তারা দু’জন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ জানালেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাল যে তাদের দু’জনকে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

আশ্চর্যের বিষয় হল যে লোকটি তাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিল সে ছিল ইউনিভার্সিটির প্রেস ডিরেক্টর। অ্যানা বললেন, আমার কাছে বিষয়টি খুবই আজব মনে হয়েছে। তদন্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এ কোন লোককে বেছে নিল!

প্রেস প্রধান হিসেবে পিটার ডানের দায়িত্ব ছিল ব্রিটেনের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃত ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা, এজন্য মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব হল, অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা।

শিক্ষার্থীদের পত্রিকা, দ্য বোয়ারে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে বিষয়টি জাতীয় গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে, ডানের এই দুই দায়িত্বপালন কিছুটা সাংঘর্ষিক। তবে তারা দাবি করে যে ওই সময়ে ডান তার প্রেস বিষয়ক দায়িত্বের কিছুটা অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন।

যদিও বিবিসি এক ই-মেইলে দেখেছে যে, ডান ওই দুই মেয়েকে জানিয়েছেন তিনি গণমাধ্যমে এই অভিযোগটির বিষয়ে একটি বিবৃতি দিতে চান এবং এ বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চান।

অ্যানা বলেন, বিষয়টি অবশ্যই সাংঘর্ষিক। যে লোক গণমাধ্যমে বিবৃতি লিখছেন তিনি আমার জীবনের এত ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে জানেন! আমার মনে হচ্ছিল আমি একটি পরাবাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে জানায়, এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে সামাল দিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই যৌক্তিক। আমরা তদন্তকারী কর্মকর্তা পিটার ডানকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। ওই দুই মেয়ের সাথে কথা বলার এক মাস পরে, চ্যাটকারী পাঁচ ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। দু’জন দশ বছর, দু’জন এক বছর এবং একজন আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত হয়।

অ্যানা এবং তার বন্ধু জানায়, তারা জানত না দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা গণমাধ্যমে এ খবর জানতে পারে। তবে তারা জানে না কোন ব্যক্তিকে কোন সাজা দেয়া হয়েছে। তবে ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দশ বছরের জন্য যাদেরকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তারা এ শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করে।

চার মাস পর, দশ বছরের জন্য বহিষ্কৃতদের সাজা কমিয়ে মাত্র এক বছর করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অ্যানা বলেন, আমাদেরকে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো কারণ জানানো হয়নি। আমাদের বলা হয়েছে যে নতুন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা জানি না সেই নতুন তথ্য-প্রমাণগুলো কী।

‘আমার মনে হচ্ছিল আমাকে হাল ছেড়ে দিতে হবে। আমরা যে দু’জন অভিযোগ করেছি, আমরা দু’জন যেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, যারা কখনোই আমাদের কথা শুনবে না।’

অ্যানা এবং তার বন্ধু শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর স্টুয়ার্ট ক্রফট তাদের জানান যে, তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা অবহেলার প্রমাণ তারা পাননি। তিনি তদন্তের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

তিন সপ্তাহ পরে, এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট এক মেয়ে শিক্ষার্থী বিষয়টি টুইটারে তোলেন, খুব দ্রুতই #শেমঅনইউওয়ারউইক ট্রেন্ডিং হতে শুরু করে।

ফলে ঘটনাটি আবারো জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তদন্ত প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছ থেকে বিভিন্ন বিভাগ নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়া শুরু করে।

কিছুদিন পরেই এক হাজার শব্দের এক বিবৃতিতে প্রফেসর ক্রফট জানান যে, ওই চ্যাটগুলো পড়ে তার মনোভাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা তার এই প্রতিক্রিয়াকে ভালোভাবে নেয়নি। তাদের কাছে এ বক্তব্য খুবই দায়সারা মনে হয়েছে।

এর তিনদিন পরে তিনি ঘোষণা দেন যে, যাদের শাস্তি কমানো হয়েছিল তারা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবে না। তবে এটা কী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত, না-কি শাস্তিপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এ বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেননি।

ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। দু’দিন পরেই, শত শত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিছিল করে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কার্যালয় অভিমূখে। প্রতিবাদের দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, ঘটনার শিকাররা যে মর্মপীড়ায় ভুগেছে, তার জন্য তারা গভীরভাবে দুঃখিত।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েদের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনামূলক কোন ব্যক্তিগত বার্তা পায়নি।

ওয়ারউইকের এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে অনলাইনে যৌন সহিংসতা এবং এ ধরনের সমস্যাগুলো রোধে কাজ করে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা ও আপিল প্রক্রিয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু করেছে, যা ২০১৯ এর সামারে শেষ হবে।

প্রফেসর ক্রফট বিবিসিকে জানান যে, তিনি আশা করেন এই পর্যালোচনা ঘটনা থেকে আমাদের নেয়া শিক্ষাকে প্রতিফলিত করবে। কিন্তু যেসব মেয়ে এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন, তারা অবশ্য মনে করেন না যে এর এর সুষ্ঠু সমাধান আদৌ হয়েছে।

অ্যানা এখন থার্ড ইয়ারে পড়ছেন। আর কিছুদিন পরে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে, এক বছরের বেশী এটা চলেছে।

‘আমি আমার গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে যেতে চাই না। আমি এখন শুধু দিন গুণছি কখন এই দিনগুলো শেষ হবে আর এমন দিন আসবে যখন আমার আর কখনো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে না।’

এসএইচ-২৮/৩০/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)