চাকরি ছেড়ে ব্যবসা, যেভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক

পড়াশোনা শেষ করে অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর সপ্ন থেকে ভাল বেতনের একটি চাকরি, যাতে ভালোভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায় বাকি জীবন। মানুষ করা যায় সন্তানাদি।

কিন্তু চাকরি বাইরেও সফল হওয়া যায়। পরিশ্রম করে বানানো যায় হাজার কোটি টাকা। যুবসমাজের জন্য এমন দৃষ্টান্তই স্থাপন করলেন ভারতের তরুণ আলবিন্দ্র।

আসুন জেনে নেওয়া যাক আলবিন্দ্রর কোটিপতি বনে যাওয়ার গল্প-

চাল-ডাল-নুন-তেল কিনতে পাড়ার মুদিখানার উপরেই ভরসা করেন অনেকে। আজকাল মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার দিয়েও সেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন মানুষ। কিন্তু বছর কয়েক আগেও এভাবে কেনাকাটায় অভ্যস্ত ছিলেন না মধ্যবিত্তেরা। এখন এই ধরনের কেনাকাটায় অভ্যস্ত অনেকে। আর এই ব্যবসা করেই সফল ভারতীয় যুবক আলবিন্দ্র ঢিনসা।

স্থানীয় জনতার কাছে হয়তো পরিচিত নন আলবিন্দ্র। তবে তার সংস্থার নাম অচেনা নয়। এককালে গ্রোফার্স নামে পরিচিত সেই সংস্থাই ব্লিঙ্কিট হিসেবে নতুন চেহারায় এসেছে। তবে নামবদল করলেও আগের মতোই দ্রুতগতিতে মুদিখানার জিনিসপত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে আলবিন্দ্রর সংস্থা। ২০২০ সালের অর্থ বছরে যার মুনাফার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৮৯ কোটি রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৬২১ কোটি টাকা।

ওই অর্থ বছরে আলবিন্দ্রের নিজের নিট আয় ছিল ১ হাজার ১৮১ কোটি রুপি। গ্রোফার্স শুরু করার ন’বছরের মধ্যেই এত রুপি কামিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।

কীভাবে শুরু হল আলবিন্দ্রের যাত্রা?

গ্রোফার্সের মতো স্টার্ট-আপ শুরু করার আগে আমেরিকার দু’টি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন আলবিন্দ্র। তারপর দেশে ফিরে জোম্যাটোতেও উঁচু পদে ছিলেন তিনি। দিল্লি আইআইটি’র স্নাতক হওয়ার পর আমেরিকায় পাড়ি দেন আলবিন্দ্র। এক সময় ট্রান্সপোর্টেশন এবং লজিস্টিক্স নিয়ে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করেন তিনি।

২০০৫ সালে আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থা ইউআরএস করপোরেশন-এ ট্রান্সপোর্টেশন অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আলবিন্দ্র। দু’বছর পর সংস্থা বদল করে কেমব্রিজ সিস্টেমেটিক্স-এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট হন। আমেরিকার ওই দুই বহুজাতিক সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরি করলেও তখন থেকেই নিজের সংস্থা খোলার ইচ্ছা পুষে রেখেছিলেন। আচমকাই সে সুযোগ এসে যায়।

আমেরিকায় কাজ করার সময়ই তার সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিওও’র সৌরভ কুমারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আলবিন্দ্রর। সৌরভ তখন কেমব্রিজ সিস্টেমেটিক্স-এ তার সহকর্মী।

চাকরি নয়, ব্যবসা করতে হবে— হঠাৎই মনে হয়েছিল আলবিন্দ্রর। এক সময় মোটা বেতনের চাকরি ছাড়ার ঝুঁকিও নিয়ে ফেলেন। এবার আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এমবিএ ডিগ্রি লাভের পর ভারতে ফিরে আসেন আলবিন্দ্র। তখনও অবশ্য নিজের স্টার্ট-আপ খোলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।

দেশে ফিরে ইন্টারন্যাশনাল অপারেশনস-এর প্রধান হিসেবে জোম্যাটোতে চাকরি শুরু করেন আলবিন্দ্র। উদ্দেশ্য ছিল, রোজগারের পাশাপাশি হাতেকলমে খাবার ডেলিভারি দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করা। ডেলিভারির সময় কী কী বাধার সম্মুখীন হতে হয়, মনোযোগী ছাত্রের মতো সেদিকেও নজর রাখতেন আলবিন্দ্র।

অ্যাপ-নির্ভর খাবার সরবরাহকারী সংস্থা জোম্যাটোয় প্রায় তিন বছর কাজ করেছিলেন আলবিন্দ্র। সে কাজ করতে করতেই নিজের স্টার্ট-আপ সংস্থার খোলার কথাও চিন্তা-ভাবনা করতেন তিনি। সঙ্গে পেয়েছিলেন তার এককালের সহকর্মী সৌরভকে। দেশে ফিরে এলেও বরাবরই সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আলবিন্দ্রর।

যদিও শুরুতে গ্রোফার্স নয়, ওয়াননাম্বার নামে একটি ডেলিভারি সংস্থা খুলেছিলেন আলবিন্দ্র এবং সৌরভ। সেটি ছিল ২০১৩ সাল। গোড়ার দিকে দোকানির থেকে জিনিসপত্র নিয়ে তা গ্রাহকদের পৌঁছে দিত ওয়াননাম্বার।

মাঠে নেমে কাজের কী কী অসুবিধা, তা জানতে আলবিন্দ্র এবং সৌরভও ডেলিভারি করেছেন। বস্তুত, চার কিলোমিটারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০-৬০টি ডেলিভারি দিয়েছেন তারা। খুঁটিয়ে জেনেছেন দোকানি এবং গ্রাহকের অসুবিধার কথাও। স্টার্ট-আপ সংস্থাটি মুনাফার মুখ দেখলেও বড়সড় লক্ষ্যভেদ করতে চাইছিলেন আলবিন্দ্র।

জোম্যাটোতে কাজ করার সময়ই তুখোড় বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত বেড়েছিল আলবিন্দ্রর। ওয়াননাম্বার শুরুর পর খেয়াল করেছিলেন, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্ডার দেওয়া হয় মুদিখানার মালপত্র এবং ওষুধ। তবে সেসব অর্ডার ঠিকঠাক দেওয়া হলেও গ্রাহক সেবা নিয়ে ভারতে বেশ ডামাডোল রয়েছে। সেই ফাঁকই ভরাট করতে চেয়েছিলেন আলবিন্দ্র। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম হয়েছিল গ্রোফার্সের। অ্যাপের মাধ্যমে লোকজনের ঘরে ঘরে চটজলদি মুদিখানার জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার সংস্থা।

২০১৩ সালে ওয়াননাম্বারের ভোল পাল্টে গ্রোফার্স শুরু করেন আলবিন্দ্র এবং সৌরভ। হরিয়ানার গুরুগ্রামে হয় সংস্থার সদর দফতর। গ্রোফার্স শুরু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই সাফল্য-ব্যর্থতা দুইয়ের মুখ দেখেছিলেন আলবিন্দ্র।

২০১৫ সালে জাপানের সফ্টব্যাংক গোষ্ঠীর সঙ্গে ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি সেরে দেশের হাইপার-লোকাল সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রথমসারিতে বসে পড়ে গ্রোফার্স। তবে ২০১৫-’১৬ অর্থ বছরে লোকসানও দেখেছিলেন। সে সময় মুনাফা ছিল মাত্র ১৪ কোটি ৩ লাখ রুপি। আর লোকসান ২২৫ কোটির। বাধ্য হয়েই সংস্থার ১০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি দেশের ন’টি শহরে অফিস বন্ধ করে দিয়েচিলেন আলবিন্দ্ররা।

ব্যর্থতার থেকেই সাফল্যের পথ খুঁজে বার করেন আলবিন্দ্র। এবার গ্রোফার্সের মোবাইল অ্যাপ ছাড়লেন বাজারে। গুরুগ্রাম, বেঙ্গালুরু-সহ বেশ কয়েকটি শহরে অর্ডার দেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে জিনিসপত্র পেয়ে যেতেন গ্রাহকেরা। দিল্লি, গুরুগ্রাম এবং বেঙ্গালুরুতে একটি ৬০ হাজার বর্গফুটের গুদামের ব্যবস্থাও করে ফেলেন আলবিন্দ্র। তাতে মুদি দোকানের জিনিসপত্র মজুত থাকত। অর্ডার এলে সেখান থেকেই মালপত্র গ্রাহকদের ঘরে পৌঁছে যেত।

অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি দেওয়ার সংস্থা ভারতজুড়ে কম নেই। রয়েছে বিগ বাস্কেট বা জিওমার্টের মতো বড় খেলোয়াড়েরাও। তবে চটজলদি ডেলিভারির দেওয়ায় লাভের মুখ দেখতে শুরু করে গ্রোফার্স।

সফল হলেও ফের গ্রোফার্সকে নয়া রূপ দেন আলবিন্দ্র। গত বছর তা নতুন লোগো এবং নাম নিয়ে বাজারে আসে গ্রোফার্স। এবার নাম দেওয়া হয় ব্লিঙ্কিট। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি দেশের ৩০টিরও বেশি শহরে শাকসবজি, মোবাইল, বইপত্র, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে আলবিন্দ্রের সংস্থাটি।

২০২১ সালে জাপান, আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা ৬৩ কোটি ডলার অর্থ ঢেলেছেন ব্লিঙ্কিটে। ভারতীয় মুদ্রায় যার অর্থমূল্য প্রায় ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি রুপি।

এসএইচ-০৮/১৬/২২ (অনলাইন ডেস্ক)