খাসোগিকে থামাতে ‘বুলেট’ ব্যবহারের নির্দেশ কার ছিল

২০১৭ সালে শীর্ষ এক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি দেশে না ফিরলে ও সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা বন্ধ না করলে তাকে থামাতে ‘বুলেট’ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম বৃহস্পতিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ খবর প্রকাশ করেছে।

তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘বুলেট’ ব্যবহারের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে চলেছে। তারা বুঝতে চাইছে, ‘বুলেট’ শব্দটি ব্যবহার করে যুবরাজ মোহাম্মদ আক্ষরিক অর্থে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, না খাসোগির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে উপমা অর্থে ‘বুলেট’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদির কনস্যুলেট ভবনে দেশটির এজেন্টদের জামাল খাসোগিকে হত্যার এক বছর আগে তাকে ‘গুলি’ করার কথা বলেছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ২০১৭ সালে ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সঙ্গে যুবরাজ মোহাম্মদের বিন সালমানের ওই কথোপকথনের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।

২০১৭ সালের জুন মাসে ক্রাউন প্রিন্স হন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। গ্রেপ্তার এড়াতে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান খাসোগি। ওয়াশিংটন পোস্টে তিনি কলাম লিখতেন। খাসোগি হত্যার পর সারা বিশ্বে তা ঝড় তোলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুবরাজ মোহাম্মদের পক্ষে সাফাই গাইলেও দেশটির সিনেটে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি তোলেন জ্যেষ্ঠ আইনপ্রণেতারা। শুরুতে এ হত্যার কথা অস্বীকার করলেও পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে হত্যার কথা স্বীকার করে সৌদি আরব। তবে এর সঙ্গে যুবরাজ মোহাম্মদ কোনোভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করেছে দেশটি।

খাসোগি হত্যায় দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওই কথোপকথন কপি করে তা বিশ্লেষণ করছে।

সূত্রমতে, মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা বিদেশি শীর্ষ ব্যক্তিদের ভয়েস ও বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগের তথ্যগুলো নিয়মিতভাবে নজরে রাখে। বছরের পর বছর ধরে ক্রাউন প্রিন্সের যেসব ভয়েস ও বার্তা সংগ্রহ করেছে, সেগুলো এখন বিশ্লেষণ করছে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাসহ অন্যান্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা।

কয়েক মাস ধরে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ক্রাউন প্রিন্সের ব্যাপারে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা, হোয়াইট হাউস ও ঘনিষ্ঠ বিদেশি সহযোগীদের সরবরাহ করছে। খাসোগি হত্যার কয়েক সপ্তাহ পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ঘটনা সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানায়, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে কর্মকর্তাদের বরাতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কথোপকথনে যুবরাজ মোহাম্মদ বলেছিলেন, খাসোগি সৌদি আরবে ফিরতে প্রলুব্ধ হবেন না, তাকে জোর করে ফিরিয়ে আনতে হবে। যদি কোনো পদ্ধতিই কাজ না করে, তাহলে খাসোগির ব্যাপারে ‘বুলেট’–এর দিকে তিনি যাবেন।

মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, ‘উইথ এ বুলেট’ বাক্যটি দিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ আক্ষরিকভাবে খাসোগিকে গুলি করে হত্যা করার কথা না–ও বলে থাকতে পারেন। হয়তো তিনি বাক্যটি উপমা অর্থে ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন যে সৌদি আরবে ফিরে না এলে খাসোগিকে হত্যার ব্যাপারে তার মত রয়েছে।

একই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলদাখিলের সঙ্গে ওই কথোপকথনের পর যুবরাজ মোহাম্মদ তার আরেক সহযোগী সৌদ আল-কাহতানিকে অভিযোগ করেছিলেন, খাসোগি দিন দিন প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। যুবরাজ বলেছিলেন, বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে তার যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা খাসোগির কলাম ও টুইটার পোস্টের কারণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। খাসোগির সমালোচনাগুলো লোকজন বেশি গ্রহণ করছে। কারণ সমালোচনাগুলো এমন এক সাংবাদিকের কাছ থেকে আসছে যিনি একসময় যুবরাজ মোহাম্মদের অ্যাজেন্ডার সমর্থক ছিলেন।

যুবরাজের অভিযোগের ব্যাপারে কাহতানি যখন বললেন খাসোগির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে, তখন যুবরাজ তাকে ধমক দিয়ে বলেন, দেশের নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা করে না।

যুবরাজ মোহাম্মদ আরও বলেন, তিনি মাঝামাঝি কোনো কাজ পছন্দ করেন না, মাঝামাঝি কাজ করে ফেলে রাখে এমন লোকদের তিনি কখনো পছন্দ করেন না, বিশ্বাস করেন না।

‘বুলেট’বিষয়ক কথোপকথনের বেশ কয়েক দিন পর ওয়াশিংটন পোস্টে খাসোগির প্রথম কলাম প্রকাশ হয়। ‘সৌদি আরব সব সময় এমন নিপীড়ক ছিল না, এখন তা অসহনীয় হয়ে পড়েছে’ শিরোনামের কলামে তিনি লেখেন, ‘আমি আমার বাড়ি, পরিবার ও চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি এবং আমি আমার কণ্ঠ তুলে ধরছি। তা না হলে কারাগারে যারা বন্দী রয়েছেন, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আমি কথা বলতে পারছি, যখন অন্যরা তা পারছে না।’

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ব্যাপারে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এবং সিআইএর মুখপাত্রের সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস যোগাযোগ করলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

আলদাখিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই সব অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। এ ধরনের ভয়াবহ অপরাধে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে ফাঁসানোর জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে, এটা তারই ধারাবাহিকতা। এই চেষ্টা নিষ্ফল হিসেবে প্রমাণিত হবে।

এসএইচ-১৯/০৯/১৯ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)