ভারতের মূল ধারার মিডিয়া যেভাবে সরকারের বশংবদে পরিণত হচ্ছে

Mumbai, Maharastra/India- February 29 2020: News from across the country. Newspapers in multiple Indian languages.

গ্লোবাল মিডিয়া ওয়াচডগ আরএসএফ বা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এ সপ্তাহেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার যে আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতের অবস্থান গত বছরের তুলনায় আট ধাপ নেমে গেছে।

১৮০টি দেশের এই ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে’ ভারতের স্থান এখন ১৫০ নম্বরে, গত বছরও যেখানে তারা ছিল ১৪২তম স্থানে।

আরএসএফের রিপোর্ট বলছে ভারতে কর্তৃপক্ষ যেভাবে সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের নিশানা করছে, তাতে সে দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোও এখন তাদের হুমকি দিয়ে বা হেনস্থা, নির্যাতন করে অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে।

মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের রেকর্ড কখনোই খুব আহামরি ছিল না, কিন্তু ইদানীং পরিস্থিতির এতটা অবনতির পেছনে কী ধরনের ফ্যাক্টর কাজ করছে?

আরএসএফের রিপোর্টে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারতের তিনটি শীর্ষ সাংবাদিক সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “এক দিকে যেমন সাংবাদিকদের কাজের নিরাপত্তা কমছে, তেমনি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা।”

প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান উইমেনস প্রেস কোর ও প্রেস অ্যাসোসিয়েশন বস্তুত একবাক্যে বলছে, “তুচ্ছ ও ঘোলাটে কারণে বিভিন্ন ড্রাকোনিয়ান আইন প্রয়োগ করে সাংবাদিকদের শুধু ভয়ই দেখানো হচ্ছে না – তাদের জীবনও অনেক সময় হুমকির মুখে পড়ছে।”

গত এক বছরের মধ্যে ভারতে যে সাংবাদিকদের এই ধরনের চরম হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের অন্যতম টাইম ম্যাগাজিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামনিস্ট রানা আয়ুব।

উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে এক মুসলিম বৃদ্ধের হেনস্থার ভাইরাল হওয়া ভিডিও টুইটারে শেয়ার করার অভিযোগে রানা আয়ুবের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল সে রাজ্যের পুলিশ।

আয়ুব বলছিলেন, “সরকারের সমালোচকদের আক্রমণ তো করা হচ্ছেই – আমার বেলায় যেদিন পুলিশ মামলা করে, ঠিক সেদিনই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তত তিনটি এজেন্সি আমাকে ও পরিবারের সদস্যদের সমন পাঠিয়ে জানতে চায়, কে আমাকে টাকাপয়সা দিচ্ছে, কেন আমি বিদেশি পত্রিকার জন্য লিখি, নরেন্দ্র মোদীকে কলঙ্কিত করার এজেন্ডায় আমি যুক্ত কি না ইত্যাদি ইত্যাদি!”

গত এক বছরের মধ্যেই লখিমপুর খেরিতে সাংবাদিক রমন কাশ্যপকে নেতার গাড়ি পিষে দিয়েছে, বিহার পুড়িয়ে মারা হয়েছে ছোট শহরের সাংবাদিক অবিনাশ ঝা-কে।

লিকার মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে প্রাণ হারিয়েছেন সুলভ শ্রীবাস্তব, খবর কভার করতে গিয়ে ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের পাতা মাইনে নিহত হয়েছেন রোহিত বিসওয়াল।

ভারত-শাসিত কাশ্মীরেও ২০১৮ থেকে জেলে আছেন সাংবাদিক আসিফ সুলতান – গত কয়েক মাসে ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে তার আরও বহু সতীর্থকে।

উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে গণধর্ষণের ঘটনা কভার করতে গিয়ে ২০২০তে আটক হন কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান – এখনো তিনি জেলেই বন্দী।

দিল্লিতে সিনিয়র সাংবাদিক স্মিতা গুপ্তা বলছিলেন ভারতে সাংবাদিকদের কাজ হয়তো বরাবরই বিপজ্জনক ছিল, তবে তাতে এখন একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

গুপ্তার কথায়, “বার্তাটা আসে একেবারে সর্বোচ্চ স্তর থেকে। ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীরা বছরে একবার হলেও সাংবাদিক সম্মেলন করতেন, বিদেশ সফরেও সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খোলাখুলি মতবিনিময়ের সুযোগ পেতেন।”

“সেই পাটটাই এখন উঠে গেছে, সরকার চায় তাদের হ্যান্ড-আউট বা বিবৃতিই হবে খবরের একমাত্র উৎস।”

“এর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেও সরকার বাছাই-করা সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যে চাপ অনেকেই আর নিতে পারছেন না।

কলকাতার বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও ‘ফোর্থপিলারউইদ্যপিপল’ পোর্টালের কর্ণধার সুদীপ্ত সেনগুপ্ত বলছিলেন – ভারতে মিডিয়ার ওপর সরকারি চাপ অতীতেও ছিল, তবু তখন কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান মেরুদন্ড সোজা রাখার সাহসটা অন্তত দেখাত।

সেনগুপ্ত বিবিসিকে বলছিলেন, “১৯৭৫য়ে ইমার্জেন্সির সময় ভারতীয় গণতন্ত্র যখন বিরাট একটা সঙ্কটে পড়েছিল, তখন থেকে যদি ধরি – ভারতীয় মিডিয়া তখনও যে বিরাট একটা বিদ্রোহী ভূমিকা নিতে পেরেছিল তা কিন্তু নয়।”

“মিডিয়ার একটা বড় অংশ তখনও কিন্তু সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছিল। লালকৃষ্ণ আডভানি যেটাকে বলেছিলেন ‘দে ওয়্যার আস্কড টু বেন্ড, বাট দে চোজ টু ক্রল’, মানে মাথা নোয়াতে বললে তারা কিন্তু হামা দিতে শুরু করে দিয়েছিল।”

“তবে মিডিয়ার একটা অংশ তখনও কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে যা বোঝায়, সেই নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার – এগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।”

কিন্তু এখন একটা চ্যানেল বা খবরের কাগজও সরকারের বিরুদ্ধে বেসুরো গাইবে – এটাই সরকারের না-পসন্দ, বলছিলেন সুদীপ্ত সেনগুপ্ত।

তিনি আরও যোগ করেন, “গত সাত-আট বছরে যে পরিবর্তনটা প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে, তা হল সামগ্রিকভাবে সমস্ত মিডিয়াকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার একটা সর্বাত্মক চেষ্টা এখন নজরে পড়ে।”

“আর প্রায় সব মিডিয়াই সেই চাপের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে।”

“এখানে একটা জিনিস হল, আজ খবরের কাগজ বা প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হল টেলিভিশন – আর সেই টিভি চ্যানেলগুলোর মালিকানা কর্পোরেট হাউসগুলোর হাতে চলে গিয়েছে।”

“এই হাউসগুলোর মালিকদের অনেককেই শাসক দল রাজ্যসভায় পার্লামেন্টারিয়ান করে পাঠিয়েছে এবং তারাও শাসক দলের এজেন্ডা অক্ষরে অক্ষরে মেনেই চলছেন।”

“ফলে সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সেন্সরশিপ জারি করার দরকারই হয়নি – মিডিয়া নিজেরাই নিজেদের ওপর সেলফ-সেন্সরশিপ আরোপ করে নিয়েছে এবং যেন সরকারেরই বশংবদ একটা শাখা হিসেবে কাজ করছে”. মন্তব্য সেনগুপ্তর।

এভাবেই ধীরে ধীরে ভারতের তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করার বা এমন কী তাদের কাজ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার ক্ষমতাও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে বলে তাঁর পর্যবেক্ষণ।

আরএসএফের বার্ষিক রিপোর্ট নিয়ে ভারত সরকার এবারেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

তবে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র সাইনা এনসি বিবিসিকে বলেছেন, “আরএসএফ কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে – ভারতের বিরুদ্ধে তারা কোনও এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে কি না সেটাও দেখার বিষয়।”

“সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের সমালোচনা হোক ক্ষতি নেই।”

“কিন্তু ভিত্তিহীন বা মিথ্যা খবর ছড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত তথা নরেন্দ্র মোদী সরকারের ইমেজে কাদা ছেটানোর চেষ্টা হলে সরকার তা রোখার চেষ্টা করবেই”, মন্তব্য করেন তিনি।

এসএইচ-২৩/০৪/২২ (শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি)