এমভি আবদুল্লাহ’র কাছাকাছি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি কোনো সুবিধা দেবে?

ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহকে নজরদারিতে রাখতে ইউরোপিয়ান যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের খবরে কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বাংলাদেশি গণমাধ্যমগুলো। অভিযান পরিচালনা না হলেও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পরিস্থিতি উত্তরণে প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। খবর বিবিসির

ইইউ নেভাল ফোর্সের তরফেও কেবল অবস্থান নেয়ার কথাই জানানো হয়েছে, অভিযানের বিষয়ে কোনো কিছু জানায়নি তারা।

জাহাজের মালিকপক্ষ বলেছে, কোনো অবস্থাতেই তারা সশস্ত্র অভিযানের পক্ষে নন।

তবে, ওই উপকূলে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এই পরিস্থিতিতে কিছু ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।

যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি যে সুবিধা দেবে

উত্তর পশ্চিম ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তায় ইউরোপিয়ান নৌবাহিনী পরিচালিত কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত নাম ‘ইইউ ন্যাভ ফর আটালান্টা’।

বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে বাহিনীটি এমভি আব্দুল্লাহর কাছে তাদের অবস্থানের তিনটি ছবি ও একটি ভিডিও প্রকাশ করে।

ইইউ নেভাল ফোর্সের সদস্যদের নজরদারির পাশাপাশি ওই আকাশসীমায় তাদের হেলিকপ্টারও টহল দিতে দেখা যায় ভিডিওতে। এমন অবস্থান জিম্মি মুক্তিতে প্রভাব রাখতে পারে বলে জানান মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনাম চৌধুরী।

প্রথমত, এত কাছে ইউরোপিয়ান বাহিনীর মতো শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি দস্যুদের ওপর একটা চাপ তৈরি করবে। যা সমঝোতার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, পূর্ব আফ্রিকার ওই উপকূল থেকে নতুন কোনো দস্যুদল সাগরে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে, দস্যুদের তৎপরতা কমে আসবে। গত দু’দিনে আরো দুটি সম্ভাব্য দস্যুতার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে ‘ইউ ন্যাভ ফর’। দুটি জাহাজই লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী।

এ নিয়ে গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে গতকাল ২১শে মার্চ পর্যন্ত ২৪টি জাহাজ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। যার মধ্যে ১২টিকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

নাবিকদের সর্বশেষ অবস্থা

বুধবার সেহরির পর পর ছেলের ফোন পান শাহনুর বেগম। তার ছেলে এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান।

বেগম জানালেন, কতটা দুঃসহ দিন পার করছেন তার ছেলেসহ অন্য নাবিকরা। ঠিকমত পানি দেয় না, খাবার দেয় না। হয়তো একবেলা ইফতার করলো, আরেক বেলা খাবার নেই।

ডাকাতরা নয়-দশদিনে প্রায় সব খাবার শেষ করে ফেলেছে বলে ছেলের কাছে শুনেছেন তিনি।

জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের সাথে তার বড় ভাই ওমর ফারুকের সর্বশেষ কথা হয় এই সপ্তাহের শুরুতে। ফারুক মঙ্গলবারজানান, জলদস্যুরা প্রতিদিন খাবার নষ্ট করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় সংকটে পড়তে হবে তাদের। তার ওপর, দস্যুদের সংস্পর্শ এবং অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে বলে অ্যালার্জি সমস্যা দেখা দিয়েছে।

এর আগে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে অনুসরণ করেছিলো।

আতিকুল্লাহ খান জানিয়েছেন, সেই সময় থেকে তাদের কেবিনের পরিবর্তে এমনকি ঘুমের সময়েও ব্রিজেই (জাহাজ চালনোর কক্ষ) অবস্থান করতে হচ্ছে।

শাহনুর বেগম উল্লেখ করেন, তিন নাতনি বলছে, বাবা কথা দিয়েছে তাদের সাথে ঈদ করতে আসবে। ঈদের আগেই ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় তিনি।

দস্যুদের সাথে আলোচনা

দ্রুত নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে চায় জাহাজের মালিক পক্ষও। কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জলদস্যুরা যোগাযোগের পর প্রাথমিক পর্যায়ের আলাপ শুরু করেছেন তারা। আনুষ্ঠানিক আলোচনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

“আমরা কোনোভাবেই সশস্ত্র অভিযানের পক্ষে নই। নাবিকদের জীবন সংশয়ে পড়বে এমন কোনো কিছুর প্রতি আমাদের সমর্থন নাই,” যোগ করেন ইসলাম। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে একই বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

জিম্মি করার আট দিন পর বুধবার দুপুরে প্রথমবারের মতো এমভি আব্দুল্লাহ’র মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে সোমালি জলদস্যুরা।

জাহাজটি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার হাতবদল করা হয়েছে। মালিকপক্ষের ধারণা, এখন অপহরণের মূল হোতাদের দখলে রয়েছে জাহাজটি।

মিজানুল ইসলাম বলেন, “শুরুতে যারা অপহরণ করেছিল তারা ছিল মূলত ভাড়াটে। এখন মূল পক্ষের সাথে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে।”

তবে নাবিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে দস্যুদের সাথে আলোচনার ব্যাপারে বিস্তারিত প্রকাশ করেনি মালিকপক্ষ।

গত ১২ই মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে ২৩ জন নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সোমালি জলদস্যুরা।

এরপর থেকেই জলদস্যুদের সাথে যোগোযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে আসছিলো জাহাজটির মালিকপক্ষ। এ লক্ষ্যে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তৃতীয় একটি পক্ষের সহায়তাও নিচ্ছিলো।

মূলত সেই মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমেই দস্যুরা জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে বলে জানিয়েছেন ইসলাম।

আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীগুলোর তৎপরতা

এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকে সোমালিয়া উপকূলে প্রবেশের আগ পর্যন্ত অনুসরণ করে আসছিলো ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধ জাহাজ।

গত শুক্রবার বিকেলে ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে চারজন অস্ত্রসহ টহল দিচ্ছে। তাদের সবার অবস্থানই ছিল জাহাজের মাস্টার কেবিনের ছাদে।

ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, গত ১২ মার্চ এমভি আব্দুল্লাহ থেকে সাহায্যের সিগন্যাল পেয়ে তারা একটি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্র্যাফ্ট-এলআরএমপি পাঠিয়েছিলো। কিন্তু ভারতীয় বিমানটি পরে আর এমভি আব্দুল্লাহর সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেনি।

পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করে। এই জাহাজটি পরের কয়েকদিন এমভি আব্দুল্লাহকে নজরদারি করে।

ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “ওরা লং রেঞ্জ সার্ভিলেন্সের জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ছবিটি নিয়েছে। কোনো দেশের জলসীমায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সে দেশের নৌবাহিনী এসেসমেন্টের জন্য ফ্লাইট পাঠিয়ে এমন ছবি নিয়ে থাকে”।

কোনো দেশের দস্যুরা নিজস্ব জলসীমায় ঢুকে গেলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই, সশস্ত্র পদক্ষেপ ভালো ফল বয়ে আনে না বলে অভিমত তার।

নিজ দেশের উপকূলে থাকে বলে জলদস্যুরা ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ও বেশি পেয়ে থাকে।

এর আগে সোমালিয়ার স্বায়ত্তশাসিত পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশে বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিল, সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে উদ্ধারের পর এমভি আব্দুল্লাহতে অভিযানের এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

পান্টল্যান্ড পুলিশও জানায় তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতে প্রস্তুত। এর আগে এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ের সাথে অভিযুক্ত দুইজনকে আটকের কথাও জানায় অঞ্চলটির পুলিশ বিভাগ।

এআর-০১/২২/০৩ (সূত্র: বিবিসি বাংলা)