’মজুরি’ নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার

বিলকিস বানুর বয়স ৩৮। পেশায় দিনমজুর, রাজশাহী মহানগরের ফুলতলা এলাকায় থাকেন। বর্তমানে মজুরি হিসেবে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা পান। তার সাথে একই কাজ করা একজন পুরুষ শ্রমিক মজুরি পান ৪০০-৬০০ টাকা। মজুরি নিয়ে এই বৈষম্যের বিষয়ে প্রতিবাদ করেও ইতিবাচক ফল মিলছে না। বিলকিসের মতো অনেক নারী শ্রমিকের একই অবস্থা। শুধু দিনমজুরিতেই নয়, অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে। তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫ এবং ২০(১)-এ শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে, জনগনের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি গ্রহণ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে।’ কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এর তেমন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই না। উপরন্তু নারী শ্রমিকের প্রতি নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তাসহ কর্মের গুণ ও মান বিবেচনা করে মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হলেও প্রায় সকল ক্ষেত্রে নারী শ্রমিক মৌলিক অধিকার বঞ্চিত, মজুরি বৈষম্যের শিকার এবং নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করে থাকে। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।

এছাড়া সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারে শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বিশেষ অনুচ্ছেদ হচ্ছে ৩৪ ও ৩৮। ৩৪ অনুচ্ছেদটি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকবচ। এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সকল প্রকার জবরদস্তিশ্রম নিষিদ্ধ। ৩৮ অনুচ্ছেদে জনশৃংঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে ২৭টি পৃথক আইনকে সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, ২০০৬ এবং গৃহ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা, ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর পাশাপাশি বাংলাদেশ চা শ্রমিক কল্যাণ তহবিল অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬ প্রচলিত আছে।

১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিল’ প্রস্তুতির উন্মেষ ঘটে। ১৯৬৬ সালে আরও তিনটি আন্তর্জাতিক দলিল প্রণীত হয়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় অন্যান্য মানবাধিকারের সাথে নিজের দেশে সরকারি চাকরিতে সমান প্রবেশাধিকারসহ কাজের অধিকার, সমপরিমাণ কাজের জন্য সমপরিমাণ মজুরির অধিকার, বিশ্রাম ও অবসর এইসব অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

১৯৬৬ সালে গৃহীত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত চুক্তির মধ্যেও জবরদস্তিমূলক শ্রম থেকে মুক্তি এবং সরকারি চাকরিতে সমতার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে অধিকার ভোগ করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে গৃহীত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির মধ্যে কাজ করার অধিকার, কাজের জন্য সঠিক ও সুবিধাজনক অবস্থা ভোগের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও তাতে যোগদানের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক বীমা প্রভৃতি ভোগ ও সংরক্ষণের অধিকার, যথাযথ জীবনযাত্রার মানের অধিকার, সর্বোচ্চ অর্জন দ্বারা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মান উন্নত করার অধিকারসহ শ্রমিক শ্রেণির বেশ কিছু অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম ১৯১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক নীতিমালা গৃহীত হয়। এই নীতিমালাসমূহে নারীকে রাত্রিকালীন কাজ কষ্টসাধ্য শারীরিক কাজ, মাইন খনিতে কাজ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। একই সাথে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা রাত্রিকালে দীর্ঘ সময় কাজ করে নারীদের বেশি উপার্জন ও বিপজ্জনক কাজ, যার ক্ষতিপূরণ বেশি অঙ্কের – সে সকল কাজ নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত কনভেনশনসমূহের বেশ কিছু বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন করেছে।

বাংলাদেশ শ্রম আইনের আওতায় এ সকল কনভেনশনের আলোকে বিভিন্ন আইন, বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ও রক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারী যেন বৈষম্যের শিকার না হয় তার বিধিবিধানও করা হয়েছে। আইএলও’র সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আইএলও সনদ, আন্তর্জাতিক শ্রম মানসমূহ এবং ঘোষণাসমূহের প্রতি সম্মান দেখাতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বরে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ আয়োজিত চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনের গৃহীত প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন-এর ১৬৭ ধারায় কর্মে নিয়োগের সুযোগ, উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং মূলধন ও প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণসহ নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেবার কথা বলা হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন-এর ১৮০ ধারায় কর্মক্ষেত্রে পেশাগত পৃথকীকরণ ও বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের নিয়োগকারী, ট্রেড ইউনিয়ন ও নারী সংগঠনসমূহের করণীয় বিষয়ে বলা হয়েছে।

প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সারাদেশে নারী-নির্যাতন বন্ধ, নারীর অধিকার ও ন্যায্য মজুরিসহ নানা বিষয়ে সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এত কিছু আয়োজন করা হলেও নারীরা যেমন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, তেমনি পাচ্ছে না ন্যায্য মজুরি ও অধিকার, এমনকি নির্যাতনেও পাচ্ছে না ন্যায় বিচার। সরকারি বা বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে আজও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য মজুরি ও পদোন্নতি পাচ্ছেন না এবং কাজের যথাযথ মূল্যও পাচ্ছেন না তারা।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারী শ্রমিকদের অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ এখন বেশ চোখে পড়ে। অথচ তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকছে দিনের পর দিন। নারী-পুরুষ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আমরা এখনও বেশ পিছিয়ে রয়েছি। আমরা শুধু কথাতেই আছি, কাজে ওমন সমান অধিকার ফলাতে পারছি না।

দেশে পুরুষদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক নারী রয়েছে যারা কিনা নিজেদের শ্রম বিক্রি করছেন। এই বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে তাদের মজুরি ও জীবনমান উন্নত করতে হবে। এজন্য নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তা শ্রম আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন। নারী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে কাজ করার সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে এবং ন্যূনতম ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করে তাদের সুস্থ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

এআর-০১/২৫/১২ (মারিয়া বিনতে মতিন)