রোজায় চাহিদার চেয়ে কম পণ্য কিনছেন ক্রেতারা

রমজানের শেষ মুহূর্তের কেনাবেচা সারতে অন্যান্য বছর যেখানে ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোয় ক্রেতাদের ভিড় জমে থাকতো সেখানে মহাখালী ও বনানী কাঁচাবাজারে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্রেতাদের তেমন আনাগোনা দেখা যায়নি। যারাও বা আসছেন তারাও পরিপূর্ণ বাজার করতে পারছেন না।

ঢাকার ওই দুটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। আগুন জ্বলছে মাংসের বাজারেও। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ- টিসিবির হিসেবে গত বছরের রমজানের চেয়ে এবারের রমজানে প্রতিটি পণ্যের দাম ১০ থেকে ৫১ শতাংশ বেশি রাখা হচ্ছে।

রমজানে ছোলার চাহিদা থাকায় কেজিতে দাম বেড়ে ৮৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসুরের ডাল ৯৫ থেকে ১৩৫ টাকা, বিভিন্ন ধরণের বেগুন ৮০ থেকে ১২০ টাকায়, শসার কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, লেবুর হালি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টমেটো কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বেসনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, সয়াবিন তেল কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১২- ১২০ টাকা কেজি দরে।

এছাড়া ডিম প্রতি ডজন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গিয়েছে।

ইফতারে প্রধান উপকরণ খেজুর। সেটাও বলা যায় নাগালের বাইরে। খেজুরের মধ্যে আজওয়া খেজুর কেজি-প্রতি ১৬০০, মরিয়ম খেজুর ৮০০ এবং মাশরুম খেজুর ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে মাংসের দামেও যেন আগুন। গরুর মাংস দোকান ভেদে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি, খাসির মাংস ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি, ব্রয়লার মুরগি ২৭০ টাকা কেজি, সোনালি মুরগি ৩৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

মূলত রমজানকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগেই বেড়েছিল, এরমধ্যে মুরগির মাংসসহ কয়েকটি পণ্যের দাম গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা বেড়েছে।

দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, তারা পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কিনছেন, তাই বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।

এদিকে, দ্রব্যমূল্য এমন লাগামহীন বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।

একেকটি পণ্যের দাম শুনে বেশিরভাগ ক্রেতা চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পরিমাণে কম কিনে বাড়ি ফিরছেন।

মহাখালীর বাসিন্দা মিতু বেগম বাজার করতে এসে তার বাজেটের সাথে চাহিদা যেন কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

তিনি বলেন, “আমার স্বামী বাইক চালিয়ে ইনকাম করে। যা ইনকাম হয়, তার চেয়ে খরচা বেশি। জিনিষের দাম তো বেশি। টাকা কম, কিনতে তো পারি না। আমার জিনিষ লাগে তিনটা, খাইতেছি একটা। খাওয়া কমায় দিসি। কষ্ট হইতেসে। কিচ্ছু করার নাই।”

আবার মহাখালী দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মর্জিনা বেগমও জানান, আয় আর ব্যয়ের ভারসাম্য হারিয়েছে তার সংসারেও।

“অন্যান্য দেশে রমজান আসলে দাম কমে, আমাদের এখানে ডবল হয়। যারা সরকারি চাকরি করে তাদের আয় বেড়েছে। বাকি মানুষের আয় তো বাড়েনাই। আমি যদি ১০ টাকা ইনকাম করি তাহলে খরচ থাকে ২০ টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন চাহিদার পুরোটা পূরণ করা যাচ্ছে না। আংশিক করতে হচ্ছে।” তিনি বলেন।

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক আহমেদও বাজারের লিস্ট অনুযায়ী সব কেনাকাটা সারতে পারেননি।

তিনি আক্ষেপের স্বরে বলেন, “সবকিছুর দামই বেশি। আজকে আর কোন সদাই নিবো না। লেবু, শসার দাম এতো বাড়তি। যেই খেজুরের গুড় ধরেন ২০০ টাকায় কিনতাম সেটা এখন সাড়ে তিনশর নীচে পাচ্ছি না। আমি রিটায়ার্ড পারসন। মনে চায় কিছু গরুর মাংস নিবো, ইলিশ মাছ নিবো। দামের জন্য পারি না। বাজেটে মিলে না। অবস্থা যে কী হবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।”

চাকুরীজীবী ইকরামুল হাসান বলেন, “দাম অনেক বেশি। আগের মতো একসাথে বেশি কেনাকাটা করতে পারি না। গত বছর যেই গরুর মাংস ৬০০/৬৫০ কেজি ছিল সেটা আজকে ৮০০ টাকায় কিনলাম। গত সপ্তাহেও ছিল সাড়ে সাতশ। আমাদের ইনকাম তো বাড়েনাই। এজন্য ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে।”

ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বছরের অন্য সময় যে হারে ক্রেতারা ভিড় করেন এবারে তার চেয়ে বিক্রি অনেক কম।

বনানী কাঁচা বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী শেখ মিরাজ বলেন, “রমজানের আগে যেমনে বেচা-বিক্রি হয়। এবারে তার কিছুই নাই। আগে যে কাস্টমার ১০ কেজি মুরগি নিতো। এখন নেয় তিন কেজি। মানুষের চাহিদা আছে। কিন্তু দাম বেশি, তাই চাহিদা মিটাইতে পারে না। মানুষ খাওয়াই কমায় দিসে। মুরগির দাম বাড়লেও আমাদের প্রফিট (লাভ) কমে গেসে। কাস্টমাররা কথা শুনায়। ফিডের দাম ৬০০ টাকারটা ১৩০০ টাকা। এইভাবে দাম তো বাড়বেই। ”

মাংস বিক্রেতা মোহাম্মদ মফিজুর জানান, “কাস্টমার তো দেখতেই আছেন। সকাল থেকে তেমন বেচা-বিক্রি নাই। শবে বরাতের পর থেকে গরুর দাম বেশি। সাপ্লাই কম। বেচা কিনা ভালো যায় না। মানুষ দাম শুইনা চইলা যায়। যারা কিনে তারা হাফ কেজি, এক কেজি কিনে। বেশি নিতে পারে না। মানুষের হাতে পয়সা নাই।”

মহাখালী কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন জানান, “রমজানের আগে কাস্টমারের মাল দিয়ে সারতে পারতাম না। এবারে কোন কাস্টমার নাই। সকাল থেকেই খালি। মাসের শেষ মানুষের পকেটে টাকা নাই। সবকিছুর রেটই বেশি। এখন মানুষ আর কেজিতে জিনিষ কিনে না। ৫০০ গ্রাম, আড়াইশ গ্রাম কিনে। পরিমাণে কমায় দিসে। আগে দিনে মিনিমাম তিরিশ হাজারের সেল হইতো আজকে ১০ হাজার সেলও হয় নাই।”

এর আগে, ১৯শে মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় বলা হয়েছিল বাজারে পণ্য-মূল্য বেশি থাকায় এই রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমতে পারে।

সরকারের বাজার মনিটরিংয়ে দুর্বলতার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কয়েকজন ভোক্তা। তবে ব্যবসায়ীরা দুষছেন যোগান কম থাকা, ডলার সংকট ও এলসি করতে না পারাকে।

এসএ-৬/২৪/২৩ (জাতীয় ডেস্ক)