বাংলাদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’ প্রতিষ্ঠিত করা হলো যেভাবে

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের কারাগারে নির্মমভাবে নিহত হন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন। অপরাধ ছিল এই, যুদ্ধনেশায় উন্মত্ত সম্রাট যখন তরুণদের প্রেম নিষিদ্ধ করে বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেছিলেন, খ্রিস্টান এই দরবেশ প্রেমিক-প্রেমিকাদের ব্যাভিচারের পাপ থেকে বাঁচাতে গোপনে বিয়ে দিতেন এবং প্রেমের পবিত্রতা রক্ষার শিক্ষা দিতেন। মৃত্যুর আগে কারাধ্যক্ষ অ্যাস্টেরিয়াসের অন্ধ মেয়ের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই দরবেশের আধ্যাত্মিক পরিচয় প্রকাশ পায়।

ওহিয়ো বেথেলপার্কে অবস্থিত সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ক্যাথলিক চার্চের সাবেক প্যাস্টর রেভারেন্ড ভিক্টর মলকার একটি লেকচারে এই তথ্য জানা যায়। ভ্যালেন্টাইনের নামে প্রতিষ্ঠিত গির্জাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী সমাগম হয় রোমের অলিম্পিক ভিলেজে অবস্থিত প্যারিশ চার্চটিতে। লাতিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ক্যাথলিক ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মার শান্তি কামনায়।

সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমের পবিত্রতা রক্ষার শিক্ষা দিয়ে গেলেও পুঁজিবাদ দিনটিকে নিয়ে গেছে মুনাফা লাভের রাস্তায়। আজকের দিনে দেশে দেশে হৃদয় আঁকা কার্ড, চকলেটের বাক্স, লাল গোলাপ, ভালোবাসা বার্তা লেখা টি–শার্ট পরা টেডি বিয়ার পুতুল প্রিয় মানুষকে উপহার দেন লোকজন। আজকের দিনে ভ্যালেন্টাইনের শহিদ দিবসটি পালনের পরিবর্তে উদযাপনের পর্ব। সেই উদযাপনও ভীষণভাবে বাণিজ্যিক।

বাংলার ঋতুবৈচিত্রে দিনটি বসন্তে পড়লেও আমাদের দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিশেষ কোনও রোমান্টিক দিবস পালনের চিন্তা মাথায় আসেনি কোনও কবি-সাহিত্যিকের। বাঙালির ভালোবাসা ছিল প্রত্যেক ঋতুতে, প্রতিদিনের জন্য, আনুষ্ঠানিকতাবিহীন। এদেশের তরুণ-তরুণীরা আত্মকেন্দ্রিক ছিল না, দেশ বা সমাজবিচ্ছিন্ন ছিল না। মনের মানুষটিকে খুঁজে নিতেন জনতার অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমে।

১৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও ১৯৮৩ সালের এইদিনে ঢাকায় ঝরেছিল শিক্ষার্থীদের রক্ত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পরের বছরই মজিদ খান প্রণীত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেন শিক্ষার্থীরা। এসএসসি কোর্স ১২ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০ শতাংশ বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার মতো কথাও বলা হয়েছিল এ শিক্ষানীতিতে।

১৯৮২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। তখনকার ১১টি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আকাশ কাঁপানো স্লোগানে এদিন নেমে আসেন রাজপথে।

সেদিন শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। উত্তেজনার একপর্যায়ে ছাত্রনেতারা ব্যারিকেডের কাঁটাতারের ওপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। তখন কোনও রকম উসকানি ছাড়াই রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছেটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। তা করতে ব্যর্থ হয়ে নির্বিচারে গুলি শুরু করে। এতে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেলে পুলিশ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ওইদিনই শিশু একাডেমিতে যোগ দিতে আসা দীপালী নামের এক শিশু গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের দীপালীর মরদেহ গুম করে ফেলে। তাছাড়া যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, পল্টন এলাকায় আরও অনেককেই গুম করা হয় বলে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনে জাফর, কাঞ্চনসহ মোট ১০ জন শহীদের হদিস পাওয়া যায়।

এর পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কাঞ্চন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেন বেগবান না হয়, সেজন্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আরও অনেক লাশ গুম করে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এর কিছুদিন পরে সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করে। ১৯৮৩ সালের পর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে বেশ কিছু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠন। কিন্তু ১৯৯২ সালের পর এই দেশে হঠাৎ ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন শুরু করেন পশ্চিমা ভাবধারায় উজ্জীবিত উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ। এরপর ধীরে ধীরে তাকে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নাম দিয়ে সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে আমদানি করার পেছনে যিনি মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণায় একমাত্র তিনিই সরব ছিলেন। বলা হয়, স্বৈরাচারের রোষানলে পড়ে শফিক রেহমানকে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নির্বাসিত থাকতে হয়েছিল। আবার ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ আড়াল করার মাধ্যমে ‘শত্রুকে’ বন্ধুতে রূপান্তরিত করেন তিনি।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শফিক রেহমান জানান, লন্ডনে নির্বাসিত থাকাকালীন তিনি দেখেছেন, বাণিজ্যিক কারণে হলেও সেখানকার স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকারা দিবসটিকে সাদরে গ্রহণ করেন। ওই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশে ফিরে আসার পর দিনটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবেন। তার ভাষায়, ভ্যালেন্টাইন ডের মধ্যে ভালোবাসার বাণী খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। তবে বাংলাদেশে শুরু করার আগে লন্ডনে প্রচলিত ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ থেকে শুরুর ‘সেন্ট’ শব্দটি ধর্মীয় কারণে বাদ দেওয়া হয়। এটি ‘ভালোবাসার দিন’ হিসেবে প্রচার শুরু হয় তৎকালীন যায়যায়দিন পত্রিকায়।

ভালোবাসা দিবস পালন শুরুর পাশাপাশি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তার অফিসের সামনে একটি সড়কের নাম ‘লাভ লেন’ রাখতে সক্ষম হয়েছেন শফিক রেহমান। আসলে তিনি নিজে যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন, তখন চট্টগ্রামে ডিসি হিলের উল্টোদিকে ছোট্ট একটি রাস্তার নাম ছিল ‘লাভ লেন’। এই লেনের শুরুতে পানের দোকান ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে এসে পান খেত। পানের আকৃতিও ছিল হৃদয়ের মতো। শফিক রেহমান যখন যায়যায়দিনের প্লট বুকিং দেন তখন সেই রাস্তাগুলোর কোনও নাম ছিল না। এ সুযোগে তৎকালীন নগরপিতার মাধ্যমে এলাকাবাসীর আগ্রহে তেজগাঁওয়ের এ রাস্তার নাম রাখা হয় ‘লাভ লেন’।

আরএম-০২/১৪/০২ (লাইফস্টাইল ডেস্ক)