রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক হামলায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক হামলা আর সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগের মধ্যে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুরুতে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ পরিস্থিতি দেখে অনেকেই তাদেরকে নিজ আঙ্গিনায় আশ্রয় দেন।

কিন্তু গত দেড় বছরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় এখন ওই রোহিঙ্গাদের দাপটে শরণার্থী মতো থাকতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

নিজেদের এমন বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা।

“রোহিঙ্গারা আঁরার জাগা জমি খসরা (নোংরা) করি ফালায়ের। লেট্রিন করছে, পায়খানা প্রস্রাব করের। গন্দর লা লামি ন ফারি। আগে একটা ঘাসের গোলা বিক্রি করি অনেক টাকা পাইতাম। এখন পাইনা। রাত্রে ঘুমাইতে ন ফারি, তারার চিল্লাচিল্লি, ঝগড়া। থামতে বইললে তো তারা দা-কামান লই, কিরিচ (ছুরি) লই আইবো। এম্নে তো মারি ফালাইবো, ইতারার জনসংখ্যা বেশি। তারারে আঁরা ডরাই, ভয় করি।”

“ওদের মায়া করে জাগা দিসিলাম। ভাবছিলাম মাস দুই পরে চলে যাবে। কিন্তু পরে ওরা আমাদের কোন কথা শুনে না। গাছ কেটে ফেলে, ফল খেয়ে ফেলে। গরুর ক্ষতি হইসে, হাস মুরগির ক্ষতি হইসে। মারামারি করে। কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে ওদের কারণে জেল খাটতে হইসে এক মাসের জন্য। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে সবকিছুর দাম বাড়া। আগে ৩০ টাকার উপরে আমরা চাউল খাইনাই। রোহিঙ্গারা আসার পর এখন ৫০ টাকা দরে চাউল খেতে হচ্ছে আমাদের। আগে আলু ছিল ১০টাকা এক কেজি। এখন ২৫টাকা।”

সবশেষ রোববার উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের দুটি গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প ইনচার্জসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌছলে রোহিঙ্গারা তাদের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ ১০জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়।

এর আগে, রোহিঙ্গাদের হামলায় তিন জার্মান সাংবাদিক ও পুলিশসহ ছয় জন আহতের খবর পাওয়া যায়।

তবে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আজ সকাল থেকে প্রতিটি ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ আবুল খায়ের।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও এর আশেপাশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পুলিশ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।। এটা সত্যি যে, মানুষ একত্রিত হলে অপরাধবোধটা কাজ করে বেশি। কিন্তু এমন পরিস্থিতি যেন না হয়, কেউ যেন আতঙ্কের মধ্যে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া আর্মি, পুলিশ, র‍্যাব বাহিনীর সমন্বয়ে টহলও আগের চাইতে জোরদার করা হয়েছে।”

তবে ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখতে রোহিঙ্গা কমিউনিটির ভেতরে প্রচারণা চালানোর কথা জানান কুতুপালং ক্যাম্প-২ এর রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নূর।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের স্থানীয় কিছু নিয়মনীতি- যেমন হেড মাঝির মাধ্যমে সালিশি মীমাংসা, অর্থদণ্ডের মতো কিছু নিয়মকানুন ক্যাম্পের ভেতরে চর্চা হয়।

এরপরও দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিটি ক্যাম্পে একটি করে পুলিশের শিবির থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

তিনি বলেন, “আমি আমার কমিউনিটিকে শান্ত হয়ে থাকতে বলি। তারা জানি ঝগড়া বিবাদ না করে। আমাদের নিজেদের কিছু নিয়ম আছে। যেমন এক ক্যাম্পের মানুষ আরেক ক্যাম্পে রাত ১১টার পরে আসতে পারবে না।”

“যদি এমার্জেন্সি কোন কাজে যাইতে হয় তাহলে হেড মাঝির অধীনে যাইতে হবে। হেড-মাঝি চেয়ার দিয়ে দিবে। তারপরও যদি প্রতিটা ক্যাম্পে যদি পুলিশ ক্যাম্প করি থাকতো। তাহলে আমরা আরও নিরাপত্তায় শান্তিভাবে থাকতে পারতাম।”

রোহিঙ্গাদের যে কোন বেপরোয়া আচরণ নিয়ন্ত্রণে সেইসঙ্গে তাদের কেউ অপরাধ করলে তাদের বিচারকাজ পরিচালনা হবে কোন নিয়মে। প্রচলিত বাংলাদেশি আইনে নাকি শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষ কোন আইন আছে?

এ ব্যাপারে জানতে কথা হয়েছিল অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনিরের সঙ্গে।

তিনি জানান, জাতিসংঘের রিফিউজি কনভেনশনে বাংলাদেশ কোন স্বাক্ষর করেনি। এছাড়া বাংলাদেশের আইনেও আলাদাভাবে কোন শরণার্থী আইন নেই। শুধুমাত্র মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র বাংলাদেশ পালন করতে পারে।

এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে যে আইন সেটা। এর বাইরে যেহেতু বাংলাদেশের কোন আইন নেই, তাই রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইন প্রযোজ্য হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ায় তাদের প্রচলিত আইনের আওতায় নিয়ন্ত্রণ করা করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন আসিফ মুনির। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ কিছু আইন প্রণয়নের কথা জানান তিনি।

এক্ষেত্রে অধিকার এবং দায়িত্ব এ দুটোর সংমিশ্রণ করলে আইনটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। তবে আইন না করলেও কিছু বিধি নিষেধ তৈরি করা যেতে পারে।

আসিফ মুনির বলেন, “আইন এবং বিধির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ধারা সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের কিছু ধারাকে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্বগুলো তাদের ক্ষেত্রে যেন সাংঘর্ষিক না হয়।”

এছাড়া এসব আইনকানুন ও বিধি নিষেধের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করে তুলতে কমিউনিটি রেডিও, স্বেচ্ছাসেবক এবং ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রচারণা চালানোর ওপর জোর দেন তিনি।

এসএইচ-১৮/১৮/১৯ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)