ভোট শেষ, তবুও আ’ লীগের তৃণমূলে কোন্দল ও সংঘাত থামেনি!

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল এবং সংঘাতের ঘটনা ঘটছে।

গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় মিলিয়ে একশোরও বেশি সহিংস ঘটনায় এ পযর্ন্ত তিন জনের মৃত্যু এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

প্রায় সবক’টি সংঘাতের ঘটনাই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যারা প্রায় সকলেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় সদস্য।

কিন্তু এখনো দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ের এসব সংঘাত নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

তবে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেছেন, “ভোটে জয় বা পরাজয়ের কারণে কোনো ধরনের উস্কানিমূলক বা একজন আরেকজনের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা যাবে না, এ নিয়ে দলের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।”

এদিকে, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে নিজ দলের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিনশোর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। এরমধ্যে ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন, অনেক আসনেই হেরেছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা।

ভোটে জয়ের পর কোনো কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।

সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে নেত্রকোনা-৩ আসনে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অসীম কুমার উকিল। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের কর্মী সমর্থকরা মিছিল বের করলে তাতে হামলা চালানো হয় বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

হামলা করার অভিযোগ ওঠে প্রতিপক্ষ অসীম কুমার উকিলের কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এতে আহত হয়ে পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন মারা যান ।

তবে, অসীম কুমার উকিল দাবি করেছেন, “বিভিন্ন জায়গায় তারা আমার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন করছে।”

নেত্রকোনার পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে।

তিনি বলেন, “কয়েকজন আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে। মূল আসামিকে ধরার জন্য চেষ্টা করছি আমরা। নির্বাচনের সহিংসতার ঘটনায় শক্ত অবস্থান নিতে আমাদেরকে বলা হয়েছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

এছাড়া, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার আরেক ঘটনায় ১৪ই জানুয়ারি নোয়াখালীতে একজন মারা গেছেন। নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করা আতাউর রহমান ভূঁইয়ার একজন পোলিং এজেন্টকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী।

এর আগে, ঝিনাইদহে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, নিহত ব্যক্তি ঝিনাইদহ-২ আসনে পরাজিত নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর সমর্থক ছিলেন।

নির্বাচনের পর গত এক সপ্তাহে সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে অন্তত দুইশো মানুষ আহত হয়েছে বলে বলছে দেশের গণমাধ্যমগুলো।

সহিংসতার খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে মুন্সিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, রাজশাহী, পিরোজপুর, খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায়।

মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে এখন পর্যন্ত ঝিনাইদহে ৪০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়ির ৪০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

ঐ জায়গাগুলোর কোথাও দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথাও বলছে সংগঠনটি।

এছাড়াও পিরোজপুর, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, পটুয়াখালী এবং রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গার হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এসব সংঘাতের একক নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায়নি, তবে বিবদমান পক্ষগুলোর প্রায় সবাই পরস্পরকে পাল্টা দোষারোপ করেছেন।

এখনো বিবাদ ও সহিংসতা চলছে এমন কয়েকটি আসনের প্রার্থীদের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিবিসির কাছে পরস্পরকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়েছেন।

তবে অনেক জায়গায় উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও প্রার্থীদের সকলের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি ।

এই মুহূর্তে যে সব জায়গায় নির্বাচনি সহিংসতা চলছে তার মধ্যে মানিকগঞ্জ-২ আসন অন্যতম। এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ।

মমতাজ বেগম বলেছেন, নির্বাচনে হারার পর প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরা মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় নৌকার সমর্থক নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালাচ্ছে।

“নৌকার পক্ষে যারা কাজ করেছে তারা কেউ বাড়ি ঘরে থাকতে পারছে না।”

এ নিয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন বলেও জানান বিবিসিকে।

যদিও এ অভিযোগ নাকচ করে দেওয়ান জাহিদ আহমেদ বলেছেন, “নির্বাচনের পর উনি (মমতাজ বেগম) আমাদের নেতাকর্মীদের ঘর থেকে ধরে ধরে এনে মারতে বলছেন। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। এখন পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাতজনকে মারধর করা হয়েছে।”

মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস অভিযোগ করেছেন, “ভোটের পর থেকেই প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে। এ কারণে ভয়ে অনেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

দাসের প্রতিপক্ষ ওই আসনের বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ফয়সালের সাথে এ নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে, বিজয়ী সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন, মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছে। কিন্তু এখনো বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত এবং সহিংস ঘটনা ঘটার কারণ কী?

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিবদমান পক্ষগুলোর কেউই সন্তোষজনক জবাব দেননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটছে।

নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ বলছেন, “ভোট তো শেষ, এখন কেন মারামারি হবে। আসলে সবাই চায় কর্তৃত্ব ধরে রাখতে।”

“যদি এই নির্বাচনে বিরোধীদল থাকতো তখন বলা হতো এই সংঘাত বিরোধী দলের কারণে হয়েছে। যতটা সহিংসতা বিরোধী দলের জন্য হয়েছে তার চেয়ে বেশি সহিংসতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নিজ দলের মধ্যে,” তিনি বলেন।

তিনি মনে করেন, তৃণমূলের এই সংঘাত শিগগিরই থামবে না।

এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও তাদের মিত্র জোটের রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ ছিল কম।

তাই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে নিজ দলের আগ্রহীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করে আওয়ামী লীগ।

ফল হিসেবে সারাদেশে দুইশোরও বেশি আসনে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ।

এর মধ্যে ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পায় নৌকার প্রার্থীদের হারিয়ে। মূলত যে সব আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হয়েছে, সে সব জায়গায় সংঘর্ষও বেশি হয়েছে।

তাহলে কী এই নির্বাচন নতুন করে তৃণমূলে সংকট বাড়ালো? আর সংঘাত এবং সহিংসতা থামাতে কী করবে ক্ষমতাসীন দলটি?

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা হয়, তবে অতীতের তুলনায় এবার অনেক কম হয়েছে।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “নির্বাচনে হার-জিত থাকবেই। ভোটে জয় বা পরাজয়ের কারণে কোন ধরনের উস্কানিমূলক বা একজন আরেকজনের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা যাবে না, এ নিয়ে দলের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।”

যদিও এখনো পর্যন্ত দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ের এসব সংঘাত নিরসনে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, এই ধরনের ঘটনায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতের নির্বাচনগুলোতে দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হতো। ফলে দলীয় কর্মীরা নৌকার প্রার্থীর পক্ষেই অবস্থান নিতো। তৃণমূল আওয়ামী লীগে তার খুব একটা প্রভাব পড়তো না।

কিন্তু এবার নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলের আগ্রহী প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করে আওয়ামী লীগ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে এ কৌশল নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ কৌশলের কারণে তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিরোধ বাড়ছে।

তবে, নির্বাচনী এই সহিংসতায় জাতীয় পর্যায়ের সরকার বা আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে বড় কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ।

তিনি বলেন, “ভোট তো এখন নাই এখন কেন মারা যাচ্ছে মানুষ? সহিংসতা শুধু নির্বাচনের দুই তিন দিনের বিষয় না।”

তিনি বলছেন, “স্থানীয় পর্যায়ে নতুন করে যে বিরোধটা চাঙ্গা করে দেয়া হয়েছে, এটা সহজে কমবে না, বরং আরও বাড়তে পারে।

এসএইচ-০১/১৫/২৪ (মুকিমুল আহসান,বিবিসি)