মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বেওয়ারিশ লাশের উপর নির্ভর!

দেশে মরণোত্তর দেহ দানের প্রতিশ্রুতি যত পাওয়া যায় দেহ তত মেলে না৷ অথচ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য মানুষের মরদেহ আর বেওয়ারিশ লাশের উপর নির্ভর করতে হয়৷

দেশে মরণোত্তর দেহ দানের কেন্দ্রীয় কোনো হিসাব নেই৷ দানের জন্য কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই৷ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে মরণোত্তর দেহদানের সুযোগ আছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এই দানে ধর্মীয় অনুশাসন অনেক সময় যেমন বাধা হিসেবে কাজ করে মেডিক্যাল কলেজগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো এনাটমি শিক্ষা৷ এর জন্য মরদেহ সরাসারি সংরক্ষণ করা হয়, আবার কঙ্কাল বানিয়েও রাখা হয়৷ তবে দেহ সংরক্ষণই করা হয় বেশি৷

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগের অফিস সহকারী আলী হোসেন জানান, ২০০০ সাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোট ৬৫ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন৷ এরমধ্যে গত বছর করেছেন দুই জন৷ গত ১৯ বছরে তারা মাত্র ১২টি দেহ পেয়েছে, এর মধ্যে তিনটি মিলেছে দান থেকে আর তিনটি বেওয়ারিশ লাশ থেকে সংগ্রহ করা৷ বাকি ৬টি আগে প্রতিশ্রুতি না দিলেও হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর দেহদান করে দিয়ে যান তাদের স্বজনরা৷ এরমধ্যে সংগীত শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী এবং ত্রিমতি চট্টোপাধ্যায় নামে আরেকজনের মৃতদেহ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কঙ্কাল বানিয়ে রাখা হয়েছে৷ মোট কঙ্কাল আছে পাঁচটি৷

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এবং নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের মরদেহও আছে এই হাসপাতালে৷ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে অথবা পোস্টমর্টেম করার পর অনেক সময় সেসব মরদেহ নেয়া হয় না৷ কিন্তু অভিজিৎ রায়ের মরদেহ বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তার পরিবারের অনুরোধে৷

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনাটমি বিভাগের প্রধান ডা. হুমায়রা নওশাবা জানান, ‘‘মরোনোত্তর দেহ দানে মানুষের আগে খুব একটা আগ্রহ ছিল না৷ তবে আজকাল তরুণরা কিছুটা আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ অনেকেই এসে কাগজপত্র নিয়ে যান৷ তবে শেষ পর্যন্ত অঙ্গীকার করেন অনেক কম৷”

তিনি বলেন,‘‘আবার যারা অঙ্গীকার করেন তাদের মৃত্যুর পর সবার মরদেহ পাওয়া যায় না৷ কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো চায় না৷ আমাদের মৃত্যুর খবর না জানালেতো আমরা জানব না৷ আর আমরা মরদেহ সংগ্রহ করি না৷ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়৷”

তিনি জানান, ‘‘মরদেহগুলো কঙ্কাল আকারে না পুরো দেহটাই সংরক্ষণ হবে অঙ্গীকারনমায় তা লেখা থাকে৷ তবে দেহ চার-পাঁচ বছরের বেশি সংরক্ষণ করা যায়না৷ আবার কেউ মৃত্যুর অনেক পর হাড়গোড়ও দিয়ে যান৷ এদের পরিবারের সদস্যরা কেউ কেউ তাদের মৃত্যু দিবসে এসে কঙ্কাল বা মরদেহ দেখে যান৷”

মরণোত্তর দেহদান করতে হলে প্রথমে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর অথবা হাসপাতালে পরিচালক বরাবর নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়৷ এরপর দেড়শ টাকার স্ট্যাম্পে আদালতের মাধ্যমে দানপত্র বা অঙ্গীকারনামার হলফনামা তৈরি করতে হয়৷ তাতে দাতা, গ্রহীতা এবং সাক্ষীদের নাম ঠিকানা থাকে৷ আবেদনপত্রের সাথে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ঠিকানা ও ফোন নাম্বারসহ পরিবারের আরো কিছু তথ্য দিতে হয়৷ পরিবারে সদস্যদের সম্মতিপত্র থাকতে হয়৷ আর মৃত্যুর পর খবর দিয়ে মরহেদ পরিবারের সদস্যদেরই পৌঁছে দিতে হবে৷ সঙ্গে ধাকতে হবে ডেথ সার্টিফিকেট৷ পুলিশ কেস এবং পোস্টমর্টেম করা মরহেদ নেয়া হয়না৷ অঙ্গীকারের পরও যদি তার সন্তান বা স্ত্রী না চান তাহলে লাশ নেয়ার কোনো বিধান নেই৷

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মোট ১৫টি মরদেহ আছে৷ এনটমি বিভাগের অফিস সহকারী আব্দুর রহিম জানান, এরমধ্যে দুইটি কঙ্কাল এবং ১৩টি দেহ সংরক্ষণ করা আছে৷ ২০০৩ সাল থেকে আরো ১৮ জন মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার করেছেন৷ ভাষা সৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, লেখক এবং সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পঙ্কজ ব্যানার্জি, নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমের ঝর্ণাধারা চৌধুরী, শিখা ব্যানার্জির মরদেহ আছে এখানে৷

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খন্দকার মানজারে শামীম নিজেও মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত যারা মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার করেন তারা তরুণ বয়সের৷ ফলে এটা পেতে সময় লাগে৷ এইসব দেহ আমরা ছাত্রদের এনাটমি শেখাতে ব্যবহার করি৷ আমাদের কাছে মরণোত্তর দেহ দান করার পর সেটার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আমাদের পক্ষ থেকে দানের কোনো সুযোগ নেই৷ সেই অবস্থায় থাকেও না৷ শুধু বোন(হাড়) চিকিৎসার কাজে ব্যবহার সম্ভব৷ এটাকে বলি আমরা বোন ডাস্ট৷”

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. উত্তম পাল বলেন, ‘‘আমরা বছরে এক-দুইটা মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার পাই৷ গত বছর একজন অঙ্গীকার করেছেন৷”

তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রদের শিক্ষার জন্য আমাদের যত মরদেহ দরকার আমরা তা পাইনা৷ এজন্য আমরা বিকল্প পদ্ধতিতে সংগ্রহ করি৷ বেয়ারিশ লাশ আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযাযী সংরক্ষণ করি৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘ধর্মীয় কারণে অনেকে আবার মরোনোত্তর দেহদানে আগ্রহী হননা৷ কেউ অঙ্গীকার করলেও দেখা যায় মৃত্যুর পর তার পরিবার আপত্তি জানায়৷ আর এনিয়ে আমাদের এখানে তেমন প্রচারও নেই৷ আমার মনে হয় প্রচার চালানো উচিত৷”

একই কথা বলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম মোস্তফা কামাল৷ তিনি জানান, ‘‘আমাদের প্রতিবছর চার-পাঁচটি মরদেহ প্রয়োজন হয়৷ কিন্তু আমরা তা পাইনা৷ বেওয়ারিশ লাশের ওপরই ভরসা করতে হয়৷”

বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে মরণোত্তর দেহদানে উদ্বুদ্ধ করছে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একটি অনুষ্ঠানেই ২২ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন৷ ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আবৃত্তিকার সাগর লোহানী জানান, ‘এপর্যন্ত একশ জনের কাছ থেকে আমরা অঙ্গীকার পেয়েছি৷ আমাদের কাজ হলো তাদের এই অঙ্গীকার অনুযায়ী মৃত্যুর পর মরদেহ হাসপাতালে দানের ব্যবস্থা করা৷ আমরা এপর্যন্ত একটি মরদেহ হাসপাতালে দান করেছি৷” সাগর লোহানী নিজেও মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন৷ প্রসঙ্গত,বাংলাদেশের আইনে মরণোত্তর দেহ দান সম্পর্কে কিছু বলা নেই৷ আইনে তাই কোনো বাধা নেই৷

এসএইচ-০৭/২১/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)