রাজাকারদের বিচার হবে

অপরাধের ধরন অনুযায়ী রাজাকারদের বিচার হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক৷ প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সরকার রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করার পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন৷

আইনমন্ত্রী বলেন, অপরাধের ধরন অনুযায়ী প্রকাশিত তালিকা ধরে এ বিচার করা হতে পারে৷ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাচাই-বাছাই করে দেখবে৷ সেখানে অপরাধের ধরন অনুযায়ী রাজাকারদের বিচার হবে৷’’

আনিসুল হক আরও বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের যে তদন্তকারী সংস্থাটি রয়েছে, তারা দেখবে যে, কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ কার অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতার মধ্যে পড়ে৷ তালিকায় থাকা রাজাকারদের অপরাধের প্রমাণ পেলে নিশ্চয় বিচার হবে৷’’

এদিকে, রোববার সরকারের হাতে থাকা নথির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর বেতনভোগী ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার এমন কোনো তালিকা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হলো৷

তালিকা প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশিষ্টজনরাও অপরাধের ধরন হিসেব করে রাজাকারদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান৷

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘‘তালিকাটি আমি ইতিবাচকভাবে দেখি৷ এখন তালিকা করে বসে থাকলে হবে না৷ এদের অপরাধের ধরন দেখে বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ তবে সাধারণ রাজাকারদের চেয়ে আল-বদর, আল শামস, আল মুজাহিদ বাহিনীর তালিকা করে তাদের আগে বিচার করতে হবে৷ কারণ এই বাহিনীগুলোর অপরাধের মাত্রা ছিল ভয়াবহ এবং নৃশংস৷ তবে এই তালিকা করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়৷ সরকারি বিভিন্ন নথি ঘাটলে তাদের তালিকা করা সম্ভব৷’’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে৷ ২০১০ সালে এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ বছরে ৪০টি মামলায় মৃত্যুদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ৯৪ জন মানবতাবিরোধী অপরাধীর৷ এর মধ্যে কারাগারে আটক রয়েছে সাজাপ্রাপ্ত ৪০ জন৷ পলাতক আসামির সংখ্যা ৪৮ জন৷ ৬ জনের বিচারের পর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হয়েছে৷ ট্রাইব্যুনাল যে ৪০টি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন সেগুলোতে আসামি ছিলেন ১০৪ জন৷ তাদের মধ্যে রায় হওয়ার আগেই কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আটজন এবং রায়ের আগে পলাতক অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে দুইজনের৷

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক হারুন হাবিব বলেন, ‘‘নতুন প্রজন্মের সামনে একটি তালিকা দিয়ে যেতে পারাও এক ধরনের সাফল্য৷ আমরাতো অনেক দিন ধরেই রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কথা বলে আসছিলাম৷ তার প্রেক্ষিতেই হয়ত এই তালিকাটি আমরা পেলাম৷ এখন এদের বিচারের পালা৷ যারা বেঁচে আছে তাদের চিহ্নিত হবে অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিচার করতে হবে৷ তবে দ্রুত যেটা করা সম্ভব, সেটা হল- ১৯৭৩ সালে ট্রাইব্যুনাল করে বঙ্গবন্ধু যে বিচার করেছিলেন তাদের অনেকেই কারাগারে ছিলেন৷ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১১ হাজার যুদ্ধপরাধীকে মুক্ত করে দেন৷ এই তালিকায় তাদের কেউ যদি থাকে তাহলে তার বিচার দ্রুত সম্ভব৷’’

রোববার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হেফাজতে থাকা দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ প্রথম তালিকা রোববারই মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে৷

তিনি বলেন, ‘‘একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, আমরা কোনো তালিকা তৈরি করছি না৷ যারা একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যেসব পুরোনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল সেখান থেকেই আমরা এই তালিকা প্রকাশ করেছি৷”

তালিকার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে? জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির  বলেন, ‘‘এই তালিকা প্রকাশ নিয়ে কৃতিত্বের কিছু নেই৷ গবেষক শামসুল আরেফিনতো ৩৩ হাজার রাজাকারের একটি তালিকা দিয়েছিলেন৷ নিয়াজীতো ৫০ হাজার রিক্রুটের কথা বলেছিলেন৷ এখন এদের তালিকার চেয়ে আল-বদর, আল শামস, আল মুজাহিদসহ যেসব বাহিনী হয়েছিল তাদের তালিকা করাটা জরুরি৷ কারণ ওই বাহিনীর সদস্যরা নির্মম, নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ করেছে৷ এই যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সেটাতো তারাই করেছিল৷ তাই কঠিন হলেও এই বাহিনীগুলোর সদস্যদের তালিকা করে বিচারের আওতায় আনাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ৷”

এসএইচ-১৫/১৬/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)