বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

ধর্ষকদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার দাবি তুলেছেন কয়েকজন সংসদ সদস্য৷ বাংলাদেশে আইন-কানুন কাজ করছে না, তাদের কথা এই বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা৷

সংসদ এবং বিচার বিভাগের প্রয়োজন নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন৷

মঙ্গলবার সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে এনকাউন্টার মাস্ট (অবশ্যম্ভাবী)৷ ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে৷ একমাত্র ঔষধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা৷” আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন৷ জাতীয় পার্টির এমপি মুজিবুল হকেরও সমর্থন পান তিনি৷

ফিরোজ রশীদ দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়া ও অপরাধীরা শাস্তির আওতায় না আসার প্রেক্ষাপটে ধর্ষকদের গুলি করে হত্যার এই প্রস্তাব দেন৷ কিন্তু মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘আইন প্রণেতাদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা অত্যন্ত বিপদজনক৷ এমনিতেই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের তেমন আস্থা নেই৷ এখন রাষ্ট্রই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা অকার্যকর৷

তাদের কথা এই বার্তা দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে আইন কানুন কাজ করছে না৷ সেটা হলে তাদের কাজ ছিলো আইন কানুন যাতে কার্যকর হয় সেই ব্যবস্থা করা৷ কিন্তু সেটা না করে তারা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও মানবাধিকার লংঘনের কথা বলছেন৷ কোনো সভ্য সমাজেই ধর্ষণ কেন, কোনো অপরাধের বিচারই ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হতে পারে না৷”

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘স্পষ্টত তাদের মন্তব্যে মনে হচ্ছে দেশে আইন, বিচার এগুলো দরকার নাই৷ এগুলো না থাকলে সংসদেরওতো দরকার নাই৷ তাদের এই উদ্ভট কথার একটাই পরিণতি দেশে বিচার ব্যবস্থার দরকার নাই, সংসদ দরকার নাই৷ এরপরও যদি তারা সংসদে বসে বেতন ভাতা নেন তাহলে তারা যা বলেছেন, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে৷ সংসদের ইতিহাসে এ ধরনের অসভ্য কথা সপ্তদশ শতাব্দীতেও বলা হয়নি৷”

ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে হত্যার এই বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ৷ তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণ প্রতিরোধে ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়৷ এটার জন্য শক্ত আইন করতে হবে৷ মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে হবে৷ ক্রসফায়ার মানবাধিকারের লংঘন৷ কাউকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা যায় না৷”

তাঁর মতে, ‘‘দেশের মানুষ বিচার পায় না৷ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে সে কারণেই হয়ত তারা ওই কথা বলেছেন৷”

সাবেক তথ্যমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু সংসদ সদস্যদের এই ধরনের বক্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন৷ তিনি মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো বিচারের দায়িত্ব বা হত্যার অনুমতি দেয়া যায় না৷ তিনি বলেন, ‘‘ওই বক্তব্যের সময় গতকাল আমি সংসদে ছিলাম না৷ আমি সংসদে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব৷ প্রয়োজনে আইন আরো কঠোর করা যেতে পারে৷ কিন্তু ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়৷ এটা অনুমোদনযোগ্য নয়৷”

তাঁর মতে সংসদ সদস্যদের এই বক্তব্যে কেউ কেউ উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারেন৷ তাই এ নিয়ে অতি দ্রুত আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত হবে সংসদে বিবৃতি দেয়া৷

সংসদে অধিবেশন চলায় এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘‘সংসদে অনেকে আবেগে অনেক কিছু বলেন৷ সবকিছু বিবেচনায় নেয়া যায় না৷ দেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থা আছে৷ আইনের বাইরে কিছু হতে পারে না৷”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০১৯, এই চার বছরে ক্রসফায়ারে এক হাজার ১২৭ জন নিহত হয়েছেন৷ ২০১৭ সালে নিহত হন ১৪১ জন আর ২০১৬ সালে ১৭৭ জন৷

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন এবং মাদকবিরোধী অভিযান ক্রসফায়ারের এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করে৷ ঐ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ৷ ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷

এসএইচ-০৪/১৬/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)