প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে ২৮ লাখ টন চাল

দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ লাখ টন চাল আমদানি হয়। আমদানি মূল্যের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় বাজারে পণ্যটির দামের স্থিতিশীলতা। অথচ বছরে নষ্ট বা অপচয় হয় ২৮ লাখ টন চাল, যা পণ্যটির মোট আমদানির চেয়ে অনেক বেশি। নষ্ট হওয়া এসব চালের আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

দেশে চাল অপচয়ের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে। ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিস্টিকস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে চালের উৎপাদন ছাড়িয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৭২ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদিত চালের ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা প্রায় ২৮ লাখ টন ক্ষতি হচ্ছে বছরে। এর মধ্যে হারভেস্টকালে ক্ষতি ১১ লাখ ২৩ হাজার টন এবং পোস্ট হারভেস্ট ক্ষতি ১৬ লাখ ৮৮ হাজার টন।

হারভেস্ট ও পোস্ট হারভেস্ট পর্যায়ে চালের বিপুল এ অপচয় রোধ করা গেলে আমদানিনির্ভরতা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, চাল উৎপাদনে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উৎপাদনেও রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। তবে খাদ্যশস্যের এ ধরনের অপচয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যেমন হুমকি, তেমনি খাদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। ধানের অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে দেশের যে ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো অনেকটাই মেটানো সম্ভব। আবার কৃষি খাতে সরকারের বড় একটি অংশ ভর্তুকি বাবদ দিতে হচ্ছে। সেখানেও খরচ কমিয়ে রাষ্ট্রের অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জরিপ বছরে আউশ মৌসুমে অপচয় হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৮২ টন চাল। এর মধ্যে হারভেস্ট বা মাড়াইকালে ৮২ হাজার ২৭৪ টন এবং পোস্ট হারভেস্ট অপচয় ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২০৯ টন। অন্যদিকে আমনে অপচয় হয়েছে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৯ টন চাল। এর মধ্যে হারভেস্টকালে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টন ও পোস্ট হারভেস্টকালে ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৭ টন চাল অপচয় হয়। বোরো মৌসুমে অপচয় হয়েছে ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৬ টন চাল, যার মধ্যে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৪২ টন হারভেস্ট ও ৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮৬৪ টন পোস্ট হারভেস্ট। সব মিলিয়ে দেশে ২৮ লাখ ১২ হাজার ৩৮৭ টন চাল অপচয় হয়েছে ওই জরিপ বছরে।

মোট ছয়টি ধাপ পেরিয়ে ধান থেকে চাল হয়। ধাপগুলো হচ্ছে ধান কাটা, হ্যান্ডলিং বা মাঠ থেকে নিয়ে আসা, থ্রেসিং বা মাড়াই, শুকানো, গুদামজাত ও পরিবহন। এ ছয়টি ধাপের প্রতিটিতেই অপচয় হয় চাল।

বিশ্বের প্রায় সব দেশে ময়েশ্চার মিটার মেশিন দিয়ে আর্দ্রতা পরিমাপ করে তারপর ধান কাটার সিদ্ধান্ত নেন কৃষক। কিন্তু দেশের মানুষ এখনো দাতে কামড় দিয়ে কিংবা চোখের দৃশ্যমান অভিজ্ঞতার আলোকে ধান কাটার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এ প্রক্রিয়ায় অপচয় হয় ১-৩ শতাংশ চাল।

ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে ব্যবহার হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। দেশে এ যন্ত্রের চাহিদা বা প্রয়োজন প্রায় ১ লাখের বেশি, যদিও ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজারের কম। প্রথাগত পদ্ধতি ধান মাড়াইয়ের ফলে এ প্রক্রিয়ায় নষ্ট হচ্ছে ২-৬ শতাংশ চাল। এছাড়া হ্যান্ডলিংয়ে ২-৭ শতাংশ, শুকানোর সময় ১-৫ শতাংশ, গুদামজাতে ২-৬ শতাংশ এবং পরিবহনে ২-১০ শতাংশ চাল অপচয় হয়।

সারা বিশ্বে ধান থেকে চাল তৈরিতে আধুনিক চালকলের ব্যবহার চললেও বাংলাদেশে এখনো ব্যবহার হচ্ছে প্রথাগত চালকল। এসব চালকলের মাধ্যমে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বেশ কম। দেশের চালকলগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাড়াই প্রক্রিয়ায় চালের ২-৩ কেজি ভেঙে যাচ্ছে প্রতি মণে। সাধারণত এক মণ ধান থেকে ৬৮ শতাংশ চাল পাওয়া গেলেও দেশের অটো রাইচ মিলে ৬২ ও সেমি অটো রাইস মিলে ৬৩ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে।

আবার সঠিক আর্দ্রতায় ধান কেটে তা মাড়াই ও ভাঙানো হলে প্রতি মণ ধান হতে প্রায় ২৮-৩০ কেজি চাল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ধানই সঠিক আর্দ্রতায় কাটা হয় না। ফলে প্রতি মণ ধান থেকে ২৫-২৭ কেজির বেশি চাল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না

এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফা হ আনসারী বলেন, ফসলোত্তর ক্ষতি কমিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ আরো জোরদার করতে হবে। প্রথাগতভাবে ধান কাটা ও মাড়াই করলে সেই ধানের ১২-১৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেশিনের মাধ্যমে সেই কাজটি করলে ক্ষতির পরিমাণ ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। অপচয়ের বড় একটি অংশই শুধু মেশিনের ব্যবহার করেই কমানো যেতে পারে। আর এসব মেশিন কৃষকের কাছে পৌঁছতে সরকারকে আরো আর্থিক ও নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ জরিপ বছরে দেশে আউশের উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ ১৩ হাজার ১৬২ টন। উৎপাদিত চালের ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশই নষ্ট বা অপচয় হয়েছে। আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮১৭ টন, যার ৭ দশমিক ৭০ শতাংশই অপচয় হয়েছে। বোরোর উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৮৭ হাজার ৬৫৮ টন, যার ৭ দশমিক ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে ওই জরিপ বছরে ৩ কোটি ৭১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩৭ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এসব চালের প্রায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশই নষ্ট হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের এ ধরনের অপচয়ের কারণে দেশের অর্থ ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এটি দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে এসডিজির যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটি বাধাগ্রস্ত করবে। অপচয় রোধে রাষ্ট্রের উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধান থেকে চাল এবং চাল থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর নানান পর্যায়ে বড় একটি অংশ অপচয় হচ্ছে। সেটি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি যেসব অপচয় হচ্ছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবহার বাড়ানোর উপায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে চাল থেকে স্টার্স, ফিশারিজ ও পশুখাদ্য হিসেবে বিকল্প ব্যবহার করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে আরো যান্ত্রিকীকরণ করতে হলে কৃষক ও জমি উপযোগী যন্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে। আবার আর্দ্রতা পরিমাপের জ্ঞান কৃষকের মাঝে ভালোভাবে সম্প্রসারণেও যন্ত্র পৌঁছানো হচ্ছে।

এসএইচ-০৭/০৫/২০ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বণিক বার্তা)