দেশে ‘করোনা জ্বর’ চলছে!

বাংলাদেশে তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর এখন দেশে রীতিমত ‘করোনা জ্বর’ চলছে৷ সরকারকে আপৎকালীন ব্যবস্থা নেযার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷

করোনার ভাইরাসের কারণে কী করা উচিৎ তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে৷ সতর্কতা হিসেবে জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে৷ কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে কীনা, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷

মুজিববর্ষ উদযাপনের বড় অংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক৷ যদিও ১৭ মার্চের মূল অনুষ্ঠানই এখন আর হচ্ছে না৷ আসছেন না বিদেশি অতিথিরা৷

করোনা ভাইরাসের নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনেও৷ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, ‘‘মুজিববর্ষ পালনের ডামাডোলে সরকার জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করেছে, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে৷” তিনি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখারও দাবি জানিয়েছেন৷

তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেছেন, পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়নি যে স্কুল কলেজ বন্ধ রাখতে হবে৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘‘বিএনপির দায়িত্ববোধ নেই, হীনমন্যতায় ভুগছে, দেউলিয়া হয়ে গেছে৷’’

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় কর্মসূচিও কাটছাঁট করছে৷ তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাজারে৷ মাস্ক, স্যানিটাইজারের মত প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক পণ্যের অভাব দেখা দিয়েছে৷ বেড়েছে দামও৷ ব্যবসা ধরতে ঢাকার কেরাণিগঞ্জে রাতারাতি গড়ে উঠেছে কাপড়ের মাস্ক তৈরির অনেক কারখানা৷ যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে সবার মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই৷

বাজারে মাস্কের পরই সবচেয়ে বেশি চাহিদা ‘হ্যান্ড ওয়াশের’৷ সরকার এরিমধ্যে স্যানিটাইজারের দাম বেধে দিয়েছে৷ চলছে মোবাইল কোর্টের অভিযান৷

চাল ডাল মজুত কেন?
করোনার পর বাজারে চাল ডালের মত নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে বলে দাবি করেছেন বিক্রেতারা৷ কলাবাগানের খুচরা ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বলেন, ‘‘যিনি একসঙ্গে ১০ কেজির বেশি চাল কিনতেন না তিনিও কিনছেন এক মন৷ ডাল, তেল , পেঁয়াজ কেনার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছেন৷’’

রহিম জানান, ‘‘কেউ কেউ মনে করছেন করোনার কারণে যদি ঘরের বাইরে না যাওয়া যায় তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তবে এই কারণে এখনো দাম বাড়তে শুরু করেনি৷’’

ঢাকার একজন গৃহিনী জানান, ‘‘করোনা নিয়ে নানা ধরনের কথা শুনছি৷ আবার সামনে রোজা৷ তাই একটু বেশি বেশি কিনে রাখছি৷’’

বিদেশ থেকে ফিরে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে

বিদেশ ফেরতরা কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করবেন তা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে৷ আইইডিসিআর তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, কেউ যদি চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, ইতালি, ইরান এসব দেশে ভ্রমণ করে থাকেন এবং ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে যদি জ্বর-কাশি-গলা-ব্যথা-শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে অতি দ্রুত আইইডিসিআর-এর হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করুন এবং কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শ নিন৷

তবে সবাইকে কি ১৪ দিন বাসায় থাকতে হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়৷ আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা স্পষ্টই বলেছি দেশের বাইরে থেকে যারা এখন ফিরছেন, তারা ১৪ দিন বাসায় (সেলফ কোয়ারেন্টাইনে) থাকবেন৷ অত্যাবশ্যকীয় না হলে তারা বাসার বাইরে যাবেন না৷ জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলেও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে৷’’

রোগী ছাড়া মাস্কের প্রয়োজন নেই
করোনা আক্রান্ত রোগী এবং এর চিকিৎসায় যারা নিয়েজিত তারা ছাড়া আর কারো মাস্ক পরা দরকার নেই বলে জানিয়েছেন ডা. আলমগীর৷ তিনি আরো জানান, ভালো করে সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধুলেই হবে৷ হ্যান্ড স্যানিটাইজার জরুরি নয়৷

কোয়ারেন্টাইন বড় কোনো বিষয় নয়
‘কোয়ারেন্টাইন’ এবং ‘আইসোলেশন’ নিয়েও সাধারণের মধ্যে আছে বিভ্রান্তি৷ চিকিৎসকদের মতে কোয়ারন্টাইন হলো সুস্থ মানুষের জন্য৷ যারা বিদেশ থেকে আসেন বা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যান তাদের আলাদা থাকা৷ যা বাসাতেই হতে পারে৷ অন্যদিকে আইসোলেশন হলো আক্রান্ত মানুষের জন্য৷

সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকতে হবে
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প, বিমান পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি, উন্নয়নমূলক প্রকল্পেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ গোলাম মেয়াজ্জেম মনে করেন, ‘‘এতদিন বাইরের বিশ্বের করোনার প্রভাব আমাদের ওপর কতটা পড়ে সটা আমাদের ভাবনার বিষয় ছিলো৷ এখন আমাদের দেশেই করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে৷ তাই অর্থনীতির ওপর প্রভাবটা এখন ভিতর থেকেই চিন্তা করতে হবে৷

আমাদের এই মূহুর্তে জরুরি হচ্ছে সরবরাহ ঠিক রাখা৷ স্যানিটাইজার ও মাস্কের চাহিদাকে হুজুগ হিসেবে না দেখে চাহিদা হিসেবেই দেখতে হবে৷ তবে এটা কার কতটা প্রয়োজন সেটা আসলে পরিস্কার করতে হবে৷ খাদ্যপণ্য মজুদকে হুজুগ বলা যায়৷ কিন্তু আতঙ্কিত মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে৷ তাকে নিশ্চিত করতে হবে সরবরাহ ঠিক আছে৷’’

এই সময়ে আপদকালীন ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি৷ কমপক্ষে তিন-চার মাসের জন্য সেটা হতে পারে৷ এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাংক যে ঋণ দেয়ার কথা বলছে সেটাও ব্যবহার করা যায়৷ তার মতে, ‘‘মূল কথা হলো মানুষকে আস্থার জায়গায় রাখতে হবে৷’’

সবশেষ পরিস্থিতি
গত ২৪ ঘন্টায় আইইডিসিআর এর চারটি হটলাইনে করোনা সংক্রান্ত কল এক হাজার গুণেরও বেশি বেড়েছে৷ ডা. আলমগীর জানান, ‘‘আমরা আগে গড়ে প্রতিদিন দেড়শর মতো কল পেতাম৷ কিন্তু তিনজন রোগীর কথা ঘোষণা করার পর গত ২৪ ঘন্টায় কল এসেছে ২৭৬৮টি৷ তাই আমরা আরো ৮টি নতুন হটলাইন দিচ্ছি৷

আইইডিসিআর মঙ্গলবার সর্বশেষ ব্রিফিং-এ জানিয়েছে করোনায় আক্রান্ত তিন জনের অবস্থা স্থিতিশীল আছে৷ তাদের বাইরে চারজন কোয়ারেন্টাইনে এবং আটজন আইসোলেশনে আছেন৷ কোয়ারেন্টাইনে থাকা চারজনের মধ্যে দুজন সৌদি আরব ফেরত দম্পতি৷

ডা. আলমগীর বলেন, ‘‘সচেতনতা দরকার ৷ আর সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে৷ আমরা আশা করি করোনা আমরা সফল ভাবেই মোকাবেলা করতে পারব৷’’

এসএইচ-০৪/১২/২০ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)