দেশে মজুদ থাকলেও কয়লা আমদানি করা হচ্ছে!

বাংলাদেশের সরকার বলছে, কয়লা খনিগুলোর ওপরের কৃষি জমির ক্ষতি ও বসতির ব্যাপারে কোন সমাধান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত স্থানীয় কয়লা খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেই সঙ্গে দেশের কয়লা উত্তোলনে যে খরচ হয়, বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে খরচ কম পড়ে বলে আপাতত কয়লার চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসি বাংলাকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলছেন, ”আমাদের দেশে কয়লার যে খনিগুলো রয়েছে, তার মধ্যে তিনটায় কয়লা উত্তোলনযোগ্য। এর মধ্যে আবার দুইটা খনিতে ভূগর্ভস্থ মাইনিং করতে হবে।

“কিন্তু সেখানে আমরা দেখলাম যে, খনির ওপরের জমিতে ধস হচ্ছে, জলাশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আর একটা খনিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করা যায়। কিন্তু সেখানেও কৃষকদের জমি আছে, মানুষের বসতি আছে। তাদের অন্য জায়গায় সরাতে হবে।”

”আর আমাদের কয়লা খনির ওপরে পানির বিরাট একটা স্তর আছে। সেটাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”

”এই বিষয়গুলোর এখনো যেহেতু আমরা সমাধান করতে পারিনি, তাই স্থানীয় কয়লা আমরা ব্যাপকভাবে উঠাচ্ছি না। এটা হলো সরকারের সিদ্ধান্ত,” তিনি বলছেন।

হামিদ জানান, দেশের কয়লার চাহিদা মেটাতে তাই বিদেশ থেকে, প্রধানত ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানেও পরিবহন জনিত কিছু সমস্যা আছে। তারপরেও দেশে উৎপাদনের চেয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করলে কয়লার খরচ কম পড়ে বলে তিনি জানান।

তবে বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনাজপুরের ফুলবাড়ি কয়লাখনির সংঘর্ষের ঘটনার কারণেই দেশীয় কয়লা উত্তোলন নিয়ে সরকারের মধ্যে একটা দ্বিধা রয়েছে।

বাংলাদেশের দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিপক্ষে আন্দোলনে ২০০৬ সালের ২৬শে অগাস্ট প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত তিনজন, আহত হয়েছিলেন অনেক মানুষ।

ফুলবাড়ির ওই ঘটনার পর থেকে ফুলবাড়ির উত্তোলন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে রয়েছে, এমনকি দেশের কয়লা উত্তোলনেও বড় কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বিবিসিকে বলছেন, জ্বালানি সেক্টরের যেসব কাজ হচ্ছে, তার মধ্যে একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে দেশীয় কয়লা উত্তোলন করতে না পারা।

এর দুইটি দিক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

”ফুলবাড়ির গণ্ডগোলের পর বাংলাদেশের একটি কয়লা-বিরোধী জোয়ার তৈরি হয়েছে। কয়লা সেক্টরের উন্নতির ব্যাপারে তার ফলে একটা নেতিবাচক মনোভাবের তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে সরকারের ভেতরে।”

”আরেকটা ব্যাপার হলো, এখানে একটা ব্যবসায়িক গ্রুপ আছে, তারা মনে করে যে, কয়লা বিরাট আকারে আমদানি করা হলে তাদের মুনাফা হবে। তারা হয়তো সরকারের ওপর একটা চাপ তৈরি করছে। এ কারণে স্থানীয় কয়লা খনিগুলোয় কাজ হচ্ছে না।” বলছেন ড. ইমাম।

কিন্তু দেশীয় কয়লা উত্তোলন নিয়ে আপত্তি রয়েছে পরিবেশবাদী কর্মীদেরও।

অ্যাকটিভিস্ট মাহা মির্জা বলছিলেন, ”শুধুমাত্র কয়লা উত্তোলন নয়, কয়লার সামগ্রিক যে ব্যবহার, কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পুরো প্রক্রিয়াটির আমরা বিরোধিতা করি।”

”কারণ আমরা মনে করি, কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়াটি পুরোটাই একটি পরিবেশ দূষণকারী প্রক্রিয়া। এবং উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লা উত্তোলন নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় যে, এটা মাটি, পানি এবং পরিবেশ, বাতাস, শস্যের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে। আবার গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হলেও সেটাও সেখানকার পরিবেশ, পানি, ফসলের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।”

”সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আরেক দফায় বায়ু দূষণ করে, পানি দূষণ করে যেভাবে উন্নয়নের পরিকল্পনা আমরা করছি, সেটা পুরোপুরি বিধ্বংসী একটা প্রক্রিয়া,” বলছেন মাহা মির্জা।

তিনি কয়লাভিত্তিক জ্বালানির বদলে পুনঃ ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দেয়ার দাবি করছেন।

বাংলাদেশ সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে মোট ২৪টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এর কারণ হিসাবে জ্বালানির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলছে সরকার।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, যেসব কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প এর মধ্যেই শুরু করা হয়েছে, সেগুলোর কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে জ্বালানির জন্য আরো পরিবেশ সম্মত উন্নত প্রযুক্তির দিকে এগোবেন বলে পরিকল্পনা করছেন।

এসএইচ-০৪/২৭/২০ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)