বাংলাদেশের মতো উদ্যোগ চান পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা

এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তাদেরকে উৎপাদনমুখী খাতে যুক্ত করা৷ এক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে তাদের নিয়ে কাজ করা অধিকারকর্মীরা৷

ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চোখে দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা৷ অথচ তাদের ক্ষেত্রে বারবার উদাসীনতার চিত্র উঠে আসে৷ চাকরির ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় পড়েন তারা৷ ট্রান্সপার্সন কবিরাগ পোদ্দার বলেন, “মার্কশিটে নাম ছিল কেতকী৷ রূপান্তরিত হওয়ার পরে কবিরাগ হয়েছি৷ নাম আলাদা হওয়ায় অসুবিধায় পড়তে হয় চাকরির ক্ষেত্রে৷ এডুকেশন সার্টিফিকেটেও নাম পরিবর্তনের দরকার৷’’

তবে সমস্যা আরো গভীরে৷ বৈষম্য ঘোচাতে দরকার সরকারি উদ্যোগের৷ ‘প্রান্তকথা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচালক বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ট্রান্সজেন্ডারদের কোনো শুমারি হয়নি৷ তাহলে সরকার পরিষেবা দেবে কীভাবে? চাকরির ক্ষেত্রে লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে বলেই অনেকে হিজড়া বা যৌনকর্মীর পেশায় চলে যাচ্ছেন৷ আর গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা তো ঘটছেই৷ বালক বা বালিকাদের হোম আছে, কিন্তু রূপান্তরকামী শিশুদের ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডার শেল্টার হোম নেই৷’’

রূপান্তরকামীদের জন্য নেই ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর মতো আলাদা প্রকল্প৷ নেই নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ৷ বাপ্পাদিত্যর বক্তব্য, ‘‘সরকারের প্রত্যেকটা দপ্তরকে সচেতন থাকতে হবে৷ সচেতনতা প্রচার ও প্রসার করতে হবে৷ কিন্তু কোনো সরকারই প্রো অ্যক্টিভ হয়ে কিছু করে না৷ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কত আলোচনা হয়৷ কিন্তু লিঙ্গ ও যৌন সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব কোথায়?’’

কোভিড পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে রূপান্তরকামীদের রেশন দেওয়া হয়েছে৷ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, হাসপাতালে ওয়ার্ড আলাদা করে না হলেও চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে৷ প্রতিটি জায়গায় সংগঠন বা স্থানীয় সরকারি আধিকারিকদের মাধ্যমে কাজ করা হয়৷ তবে, শুমারি সরকারের কাজ নয়, নির্বাচন কমিশনের কাজ বলে দাবি বোর্ডের৷

ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছত্তিশগড়, ওড়িশা, বিহারে পুলিশ, সিভিক পুলিশে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে তেমন উদ্যোগ কোথায়, এই প্রশ্ন তোলেন দীর্ঘদিনের ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের মুখ রঞ্জিতা সিনহা৷ কেন্দ্রীয় সরকারের গরিমা গৃহ প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন তিনি৷ তবে বাবার পেনশন পরবর্তীতে পাননি বলে অভিযোগ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশের মধ্যে কলকাতায় রূপান্তরকামী আন্দোলন অনেক আগে শুরু হয়েছিল৷ কিন্তু অন্যান্য রাজ্য ট্রান্সজেন্ডারদের জীবিকা, পেনশন ইত্যাদি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে৷’’

উপমহাদেশের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে৷ বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি কোন প্রতিষ্ঠান মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয় তবে কর্মচারিদের পরিশোধিত বেতনের ৬৫ শতাংশ বা প্রদেয় করে পাঁচ শতাংশের মধ্যে যেটি কম তা নিয়োগকারীদের কর রেয়াত হিসেবে দেয়া হবে৷ এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বার্ষিক সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কর দিতে হবে না৷ সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে এই করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা৷

এই কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে পথপ্রদর্শক৷ পশ্চিমবঙ্গের ট্রান্সজেন্ডার তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা চান ভারতেও যেন এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়৷

ট্রান্সপার্সন আইনজীবী অঙ্কন বিশ্বাস ঢাকার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘‘এমন প্রকল্প যদি ভারত সরকারের তরফ থেকে আগামী দিনে আসে, তাহলে অবশ্যই গোটা সম্প্রদায় খুব উপকৃত হবে৷ আমাদের সমাজে মানুষ এখনও চায় ট্রান্সজেন্ডাররা সমাজে শ্রম দেবে৷ কিন্তু এদের শ্রম কাউন্ট করা হবে না৷ পিছিয়ে পড়া মানুষদের আরো পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে৷’’

রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাংলাদেশের এই নীতিকে সমর্থন করছি৷ মানুষকে কাজ দিতে হবে৷ আগামী দিনে আমাদের সরকারও নিশ্চয়ই ভাববে৷ সরকারের সঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তা হয়েছে আমাদের৷ রেশন বা ভাতা দিয়ে সমস্যা সমাধান হবে না৷ জীবিকার মাধ্যমেই কর্মমুখী করতে হবে গোষ্ঠীকে৷’’

এসএইচ-১০/০৪/২১ (পায়েল সামন্ত, ডয়চে ভেলে)