স্কুলে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার পরিবেশ কতোটা আছে?

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর স্কুলে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও যৌন বা প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলার বিষয়ে সংকোচ দেখা যায়।

এর আগেও দেখা গিয়েছে বয়ঃসন্ধীকালীন পরিবর্তন বিষয়ক অধ্যায়গুলো শিক্ষকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে নতুন এই পাঠ্যক্রম সংযুক্তির বিষয়টি কতোটা সফল হতে পারে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ঢাকার বাসিন্দা অনন্যা আহমেদ যখন স্কুলে পড়তেন তখন তার একটি পাঠ্যবইয়ে বয়ঃসন্ধীকালীন পরিবর্তন ও সচেতনতা বিষয়ক অধ্যায় থাকলেও সেটি তাকে বা তার সহপাঠীদের কাউকেই পড়ানো হয়নি।

তিনি জানান, “ঢাকার একটা নামকরা স্কুলেই পড়েছি। সেখানকার টিচাররা এসব চ্যাপ্টার নিয়ে আলোচনা তো দূরে থাক, কোন ক্লাসই নেয়নি।

”ওটা মেয়েদের স্কুল ছিল, তারপরও স্কিপ করেছে। টিচার বলেছিলেন বাসায় পড়ে নিতে।”

দেশের স্কুলগুলোর বাস্তবতা যখন এমন এরিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পাঠ যুক্ত করা হবে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপিএ এর তৈরি করা শাহানা কার্টুন শ্রেণীকক্ষে দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের এই পাঠ দেয়া হবে।

শাহানা কার্টুনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন, প্রজননস্বাস্থ্য সেইসঙ্গে লিঙ্গ-সমতা ও অধিকারের বিষয় পাঠ দেয়া হবে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

কিন্তু এসব বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।

ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফেরদৌস বেগমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার কণ্ঠেও সংকোচের ছাপ ছিল স্পষ্ট।

“এসব বিষয়ে তো আমরা কেউ এভাবে আলাপ করি না। গার্জিয়ানরাও চান না বাচ্চাদের এতো কিছু জানানো হোক,” তিনি বলেন।

”আমরা ক্লাসে এসব পড়াতে গেলে আমরাই ঝামেলায় পড়তে পারি। আর ছেলে মেয়ে একই ক্লাসে থাকলে তাদেরকে এসব বিষয়ে পড়ানোটা কঠিন।

”এতো কিছু ডিটেইল তো বলা যায় না। বোঝেনই তো। ” বলছিলেন মিসেস ফেরদৌস।

দেশে সামাজিকভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে দেখা যায় না। এমনকি যৌন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের সাথে কথা বলতেও অনেক সংকোচ বোধ করেন।

এ কারণে সমাজে ভ্রান্ত ধারণাগুলো দানা বাধার সুযোগ তৈরি হয় বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম।

এই সংকোচ বা অচলায়তন ভাঙ্গতে শিক্ষক- শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন যারা এ বিষয়ে পাঠ দেবেন সেই শিক্ষকদের এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে।

তিনি বলেন, যারা শিক্ষক তারা কতোটুকু প্রস্তুত, জ্ঞানের দিক থেকে এবং পড়ানোর মানসিকতার দিক থেকে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তুলতে হবে, সংকট কাটাতে হবে।

সেই সাথে অভিভাবকদেরও এই সচেতনতার সাথে যুক্ত করা জরুরি বলে মনে করছেন মি. ইসলাম।

এরই মধ্যে শাহানা কার্টুনটির সিডি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিতরণের লক্ষ্যে সব জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।

এ বিষয়ে পাঠদানকে সব মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন । অধিদফতরের প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য।

এরিমধ্যে আড়াইশ স্কুল ও ৫০টি মাদ্রাসায় পাঠদান কার্যক্রমের সাথে যারা যুক্ত তাদের সবাইকে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

আগামী বছরের মধ্যেই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রতিটি স্কুলে ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে তিনি আশা করছেন।

“আগে শুধু বইয়ের মধ্যেই শুধু একটা দুটো চ্যাপ্টারে বিষয়গুলো পড়ানো হতো। কিন্তু এবারে আমরা শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সচেতন করে তুলতে কাজ করছি,” তিনি বলেন।

”পাঁচটি জেলার শহুরে স্কুল আবার প্রান্তিক অঞ্চলের স্কুল, মাদ্রাসা সব জায়গায় এই কর্মসূচি চালানো হয়েছে। সেখানে বেশ ভালো ফল পেয়েছি বলেই, এবার আমার সিরিয়াসলি এগোচ্ছি।”

এই কর্মসূচির আওতায় প্রথমে প্রতিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং শ্রেণী শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পাবেন।

সেখানে এই শিখন পদ্ধতি কিভাবে পরিচালিত হবে, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে জানা এবং সেটা পড়ানো কেন জরুরি, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

অভিভাবকদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে এই শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝানো হবে বলে তিনি জানান।

সেই সাথে প্রতিটি স্কুলে বয়ঃসন্ধি ক্লাব করা হবে, যেখানে বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ২১ হাজার স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীতে এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী আছে।

এই শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পাঠ সঠিকভাবে দিলে এবং শিখন পদ্ধতি নিয়মিত মনিটর করলে এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সফল হবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।

এসএইচ-০২/০১/২২ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)