রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূলবৃদ্ধির পরিস্থিতি এখন দেশটির রাজনীতিতে বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিরোধীদল বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করছে।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, ভোজ্য তেল, চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে সরকার স্বীকার করছে না এবং সে কারণে সংকট বাড়ছে।

কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী কয়েকটি দলের একটি জোট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার’ অভিযোগ তুলে ২৮শে মার্চ সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে।

তবে সরকার ব্যর্থতার এ অভিযোগ মানতে রাজি নয়।

নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে বিরোধীদল বিএনপি এবার এই ইস্যুতে চুপ থাকেনি।

দলটি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মাঠে কর্মসূচি দেয়া অব্যাহত রেখেছে।

বিএনপি এখন ঢাকা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সমাবেশ বা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে এক সপ্তাহ ধরে।

দলটি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়কে রাজনৈতিকভাবে দেখছে এবং সেজন্য তারা ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভোজ্যতেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও রাজনৈতিক চিন্তা থেকে সরকার পরিস্থিতিটাকে স্বীকার করছে না।

“সংকটটাকে স্বীকার না করা-এটা বড় সমস্যা।”

একই সাথে আলমগীর অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীদের যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট র্সষ্টি করছে, তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।

“বাজারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তৎপরতা চালাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটগুলোর সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত রয়েছে” বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি মনে করেন, জবাবদিহিতা না থাকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

বিএনপির পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে। বামপন্থী দলগুলো বিক্ষোভ বা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।

কমিউনিস্ট পার্টি সহ কয়েকটি বামপন্থী দলের একটি জোট হরতালের কর্মসূচিও নিয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অভিযোগ করেন, পরিস্থিতিটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে এনিয়ে উপহাস করছেন।

“মন্ত্রীদের কেউ বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কী হবে-মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আবার কেউ বলছেন, মানুষ না খেয়ে নাই। এ ধরনের উপহাস মন্ত্রীরা করছেন” – বলেন রুহিন হোসেন প্রিন্স।

তিনি উল্লেখ করেন, তাদের বামপন্থী জোট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন।

প্রথমত: নিত্যপণ্যের চালসহ যে অংশ দেশে উৎপাদিত হয়, এগুলো চাতাল ব্যবসায়ী বা চালকল মালিক বা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে যায়। এরসাথে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় দাম বৃদ্ধি পায়।

সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা।

দ্বিতীয় কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন কিছু পণ্যের বাজারে এক শ্রেণির আমদানিকারকের নিয়ন্ত্রণকে। “আমদানি নির্ভর তেল চিনির রাজত্বের মধ্যে আমরা আছি। এক্ষেত্রে কয়েকজন খাদ্য বিধাতা আছেন। তারা যেভাবে বলেন, সেভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ হয়” বলেন রুহিন হোসেন প্রিন্স।

বাজার পরিস্থিতির কারণে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের এবং এমনকি মধ্যবিত্তরা যখন অসহায় অবস্থায় রয়েছেন, তখন ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের সরকারি পদক্ষেপ নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।

সরকার টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে করে ভোজ্যতেলসহ যে সব পণ্য বিক্রি করছে, সেই ট্রাকগুলোকে ঘিরে অসহায় মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এসব ট্রাক থেকে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিস্থিতি যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে এই বাজার সংকট দেশের রাজনীতিতে একটি বড় ইস্যু হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরিন বলেন, “যেহেতু সাধারণ মানুষ ভূক্তভোগী এবং সমাজে দাপটে মধ্যবিত্তকেও আঘাত করছে। সেকারণে এটি বড় আকারে রাজনৈতিক ইস্যু হতে পারে। যদি সরকার এখনই নজর না দেয়” বলেন মিজ নাসরিন।

এদিকে, সরকারের মন্ত্রীদেরও অনেকেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের কেউ এমন অভিযোগও তুলেছেন যে, বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ীদের একটা চক্র নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

তবে সরকার এবং আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, সাধারণ মানুষের মদ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।

সিনিয়র মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, তারা সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায়, এবার কৃষিপণ্য সার এর জন্য ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তূকি সরকারকে দিতে হচ্ছে। এই ভর্তূকির পরিমাণ এতদিন সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা ছিল। সারে ভর্তূকির কারণে অনেক নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে।”

তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকারের ব্যর্থতা বা সিন্ডিকেটের তৎপরতার যে সব অভিযোগ করেছে. মন্ত্রী ড: রাজ্জাক এসব অভিযোগ নাকচ করে দেন।

তিনি বলেন, “কোন সিন্ডিকেট নেই।”

তিনি মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।

কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাতে সন্দেহ প্রকাশ করছে।

এসএইচ-০৬/১২/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)