দেশে পোশাক পরার স্বাধীনতা নিয়ে যত কথা

টিপ পরা নিয়ে এক নারীকে সম্প্রতি এক পুলিশ সদস্যের কটূক্তি বেশ আলোচিত হয়েছে৷ পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে কথাও হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ এই স্বাধীনতা কতটুকু আছে বাংলাদেশে? আইন ও সংবিধান কী বলছে?

টিপ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে হিজাব পরার স্বাধীনতা৷ আর না পরার স্বাধীনতাও উলটো পিঠের আলোচনায় আছে৷ হিজাব নিয়েও কটূক্তি হয়েছে৷ আবার জিন্স প্যান্ট পরার কারণেও নারীকে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে৷ এই সব ঘটনার মধ্যে ধর্মান্ধতা যেমন আছে, তেমনি ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থানও আছে৷ এমন নানা বিতর্কের মধ্যে পোশাকের কোনটি ধর্মীয় আর কোনটি ঐতিহ্যের, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷

টিপ পরায় নারীকে হেনস্তাকারী পুলিশ সদস্যের পক্ষ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর পোস্টও দেখা গেছে৷ তারা ওই পুলিশ কনস্টেবলকে ‘নুরানী চেহারার ইসলাম প্রিয় ভাই’ বলে সম্বোধন করে তার অপকর্মকে নানাভাবে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন৷

সামাজিক মাধ্যমে হিজাব নিয়েও কটাক্ষ করতে দেখা যায়৷ এছাড়া নিজস্ব পছন্দের পোশাক পরার কারণে সামাজিক মাধ্যমে অনেককে ‘চরিত্রহীন’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে হরহামেশাই৷ ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা তো বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷

কিন্তু বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানে নারী-পুরুষের পোশাকের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘আমাদের সংবিধানে পোশাকের বিষয়ে কোনো বাধানিষেধ নাই৷ যার ইচ্ছা হবে হিজাব পরবে, যার ইচ্ছা হবে জিন্স, টি-শার্ট পরবে৷ তবে কেউ যদি আবার পোশাকই না পরেন সে ব্যাপারে আইনে বাধা আছে৷ এটাকে আইন পাবলিক ন্যুইসেন্স হিসেবে দেখে৷ সেটার জন্য কেউ আইনের আওতায় প্রতিকার পেতে পারেন৷”

তার কথা, যদি কোনো নারীর পোশাক, টিপ বা সাজগোজের জন্য কেউ তাকে কুরুচিপূর্ণ, ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গি করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির মামলা করতে পারেন৷

তবে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ড্রেস কোড থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷ সেই ড্রেস কোড মেনেই শিক্ষার্থীদের সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে৷ ড্রেস কোড বিষয়টি প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে জানান ইশরাত হাসান৷

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, ‘‘এখানে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু এটা কারুর উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না৷ কেউ ধর্মীয় পোশাক পরতে পারেন আবার কেউ নাও পরতে পারেন৷ এটা যার যার স্বাধীনতা৷ ব্যক্তির স্বাধীনতা আছে৷ প্রাইভেট লাইফের স্বাধীনতা আছে৷ আছে স্বাধীনভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা৷ এটা কারুর পছন্দ বা অপছন্দ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না৷”

সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে তারই প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিভাগের অধ্যাপক মো. শেখ ফরিদ৷ তার কথা, এখানে মৌলবাদের প্রভাবও বাড়ছে৷ এই মৌলবাদ সব ধর্মের মধ্যেই আছে৷ ব্যক্তির আচরণেও মৌলবাদ প্রকাশ পাচ্ছে৷ একজন যেটা বিশ্বাস করে তার বাইরে কিছু হলেই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো ধর্মই অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের কথা বলেনি৷ কিন্তু সেটা আমরা ধর্মের নামে দেখতে পাচ্ছি৷”

অধ্যাপক ফরিদ বলেন, ‘‘কেউ টিপ পরবেন, কেউ পরবেন না৷ এটা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়৷ কেউ ধর্মীয় পোশাক পরতে পারেন, কেউ না পরতে পারেন৷ কেউ দাড়ি রাখতে পারেন, কেউ নাও রাখতে পারেন৷ এটা যার যার ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা৷ এটা নিয়ে জোর জবরদস্তি চলে না৷”

তিনি জানান, ‘‘কোনো নারী জিন্স, টি-শার্ট পরলে যেমন কখনো হেনস্তার শিকার হন৷ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কেউ হিজাব পরার কারণে তাকে আলাদা গোত্রের বলে চিহ্নিত করা হয়৷ দুইটিই অগ্রহণযোগ্য৷”

তার কথা, একই ধর্মের মধ্যেও নানা গ্রুপ, উপ-গ্রুপ থাকতে পারে৷ তাদেরও তাদের মতো স্বাধীনতা আছে৷

বাংলাদেশে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতির একটা টানাপোড়েন দীর্ঘদিন ধরেই চলছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যাণ্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ৷ তবে তার কথা, ‘‘আমি মনে করি বাঙালি ঐহিত্যকে ধারণ করেই এই জনপদের মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে৷ বঙালির উন্নয়ন, উন্নতি তার নিজস্ব ঐতিহ্যের হাত ধরেই হবে৷”

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে পোশাক নিয়ে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে৷ কেউ চাইলে হিজাব পরবেন, এটা তার স্বাধীনতা৷ আবার কোনো নারী চাইলে জিন্স টি-শার্ট পরবেন, এটা তার স্বাধীনতা৷ কিন্তু ৯০-এর পর থেকে এখানে মধ্যপ্রাচ্যের কালচার আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এর জন্য বিনিয়োগও হচ্ছে বলে জানান তিনি৷

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘পেশার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ একজন পুলিশ সদস্য এক নারীর টিপ পরা নিয়ে কোনোভাবেই মন্তব্য করতে পারেন না৷ এটা তার পেশার সাথে কোনোভবেই যায় না৷”

তিনি মনে করেন, ‘‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবার ও সামাজিক ব্যবস্থায় গলদ আছে৷ যার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি৷”

এসএইচ-০৩/০৯/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)