শিশুদের মধ্যে দেরিতে কথা বলতে শেখার প্রবণতা বাড়ছে

শিশুদের মধ্যে দেরিতে কথা বলতে শেখার প্রবণতা বাড়ছে৷ এটা এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়ের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে৷ এটা কেন হচ্ছে? এর দায় কার এবং সমাধানই বা কী?

জিগাতলা এলাকার এক দম্পতির সাত বছর বয়সি সন্তান আছে৷ এই মেয়ে শিশুটি এখন কিছু শব্দ বলতে পারে৷ তবে কথা বলায় তার কোনো আগ্রহ নেই৷ সে সব কিছু ইশারায় বলতেই পছন্দ করে৷ কেউ যদি তার সামনে কিছু বলে তখন সেটা সে অনুকরণ করে বলতে পারে৷ কিন্তু পরে আর সেই সব শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে না৷

তার বাবা জানান, সে মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনের প্রতি অতি মাত্রায় আসক্ত৷ এগুলো সরিয়ে বা বন্ধ করে রাখলে সে রেগে যায়৷ যেকোনো উপায়ে সে এগুলো দখলে নেয়৷ চিকিৎসকরা এখন শিশুটিকে স্পিচ থেরাপি দিচ্ছেন৷ তারা তার দেরিতে কথা বলা ছাড়া মানসিক বিকাশে আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না৷

তার বাবা স্বীকার করেন একদম ছোটবেলা থেকেই তাকে মোবাইল ফোন দিয়ে বা টেলিভিশন চালিয়ে খাবার খাওয়ানো হতো, শান্ত রাখা হতো৷ এটা কেবল একটি পরিবারের চিত্র না৷ একই পরিস্থিতি আরো অনেক পরিবারে৷ চিকিৎসকরাও বলছেন এই প্রবণতা বাড়ছে৷ এভাবে চলতে থাকলে শিশুদের নিয়ে বড় বিপদ হতে পারে৷ এমনকি কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথা নাও বলতে পারে৷

শিশু চিকিৎসক ও মনোচিকিৎসকরা বলছেন, নানা কারণে শিশুরা দেরিতে কথা বলতে পারে৷ এটা বংশগত বা মস্তিষ্কে কোনো সমস্যার কারণেও হতে পারে৷ তবে এই সময়ে বিশেষ করে শহর এলাকায় শিশুদের বাবা-মা সময় না দেয়ায় তারা দেরিতে কথা বলছে৷ তারা যে কথা শিখবে তার আগে তাদের কথা শুনতে হবে৷ আর এটার ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ না হলে তারা কথা বলা শিখবে না৷

যদি একক পরিবার হয় এবং বাবা-মা দুইজনই কর্মজীবী হন তাহলে শিশুদের এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি বলে মনে করেছেন তারা৷ অনেক বাসায় গৃহকর্মীরা শিশুদের মোবাইল ফোন দিয়ে বা টিভি ছেড়ে বসিয়ে রাখে৷ তখন যোগাযোগ হয় এক পাক্ষিক৷ শিশুটি শুধু শোনে৷ বলতে শেখে না৷ এটা হলো ‘কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার’৷

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, ‘‘এটার কোনো জরিপ নেই৷ তবে আমরা এখন শিশুদের এই ধরনের সমস্যা বেশি পাচ্ছি৷”

তিনি বলেন, ‘‘শিশুরা যদি আট বছর বয়সেও কথা বলতে না পারে তাহলে সেটা ভয়ের৷ তখন তাদের আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কথা বলানো সম্ভব নয়৷ তাদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ও কেয়ার প্রয়োজন হয়৷”

তিনি বলছেন, শিশুদের যদি বাবা-মা সময় না দেয়, সে যদি ডিভাইস নির্ভর হয়ে পড়ে তাহলে যে তার পরিবেশের কারণেই ঠিক সময়ে কথা বলতে পারবে না৷

সাধারণত একটি শিশু এক বছর বয়স থেকে কথা বলা শুরু করে বলে জানান শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল আলম৷ তিনি বলেন, ‘‘যাদের কথা বলতে দেরি হয় তাদের মানসিক বৃদ্ধি দেরিতে হয়৷ দুই বছরে শিশু দুই-চারটি শব্দ বলবে৷ সেটা যদি সে আট বছরে বলে তাহলে তার মানসিক বয়স দুই বছর, যদিও ফিজিক্যাল বয়স আট বছর৷”

তিনি জানান, এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে এখন দেখা যাচ্ছে৷ কারণ শিশুদের বাবা- মা সময় না দিয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নির্ভর করে তুলছে৷ মোবাইল ফোন হলো ওয়ান ওয়ে৷ এদিয়ে শিশু কথা শেখে না৷ ফোনের ডিসপ্লেই হয়ে যায় তার পৃথিবী৷ কোনো কিছু শেয়ার করা, কথা বলা তার চিন্তার বাইরে থেকে যায়৷

তাই শিশুদের সময় দিতে হবে৷ তাদের কাছ থেকে ডিভাইস দূরে রাখতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি৷

তিনি জানান, কথা বলতে দেরি হলে স্পিচ থেরাপিসহ নানা চিকিৎসা আছে৷ শিশুর ফিজিকাল বয়স ও মানসিক বয়স পরিমাপ করে ব্যবস্থা নেয়া হয়৷

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনোচিকিৎসক অধ্যাপক ড. হেলালউদ্দিন জানান, ‘‘এটা আসলে শিশুদের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার৷ আমরা জরিপে দেখেছি শিশুদের শতকরা ১৩ ভাগ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে৷ তাদের মধ্যে শতকরা ছয় ভাগ অটিজমসহ কম্যুনিকেশন ডিজঅর্ডারের সমস্যায় ভোগে৷”

তিনি বলেন, ‘‘শিশু তার প্রথম বছরেই মানে ১২ মাসের মধ্যে বাবলিং করবে৷ আর ছয় বছরের মধ্যে পুরো কথা বলা শিখে যাবে৷ এরচেয়ে দেরি হলে চিন্তার কারণ আছে৷”

শিশু ঠিক সময়ে কথা না বললে সাধারণভাবে অভিভাবকরাই এর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘শিশুর সাথে কথা বলতে হয়৷ তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করতে হয়৷ এটা তো যন্ত্র করবে না৷ আর শিশুদের অনেক সময় চুপ করিয়ে দেয়া হয়৷ কথা বলতে বারণ করা হয়৷ এটাও ক্ষতিকর৷”

তিনি শিশুদের সঙ্গে বাবা-মার কোয়ালিটি সময় কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক করার পরমর্শ দেন৷

এসএইচ-০১/১৭/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)