সিংহ দম্পতির সংসারে অশান্তি

কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বিপরীত লিঙ্গের সিংহ রয়েছে দুই জোড়া। এর মধ্যে সম্রাট ও নদী দম্পতির মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকতো। ঝগড়া-বিবাদেই কাটত দুটির সময়।

সবশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নদীর গলা ও পেটে কামড় বসিয়ে দেয় সম্রাট। সেই থেকে আলাদা কক্ষে একাকী কাটছে নদীর জীবন। পানি ছাড়া কিছুই মুখে তুলছে না নদী; তার জীবন এখন সংকটাপন্ন।

জানা যায়, নির্দিষ্ট বেষ্টনীতে থাকাবস্থায় গত ২ ফেব্রুয়ারি তারা মারামারিতে (কামড়াকামড়ি) লিপ্ত হলে উভয়েই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে বেশি চোট পায় পুরুষ সিংহ সম্রাট। তখন পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হলে সুস্থ হয়ে ওঠে উভয়ই। কিন্তু ১৭ দিনের মাথায় ওই দম্পতি বেষ্টনীতে ফের মারামারিতে লিপ্ত হয়। এতে এবার বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নদী। তার গলার নিচে রক্তাক্ত জখম হয়। এরপর থেকে সেই ক্ষতস্থান দিয়ে অনবরত ঝরতে থাকে পানি।

এই যাত্রায়ও ডাক্তার দ্বারা পার্ক কর্তৃপক্ষ উভয়ের চিকিৎসা করায়। তবে পুরুষ সিংহ সম্রাট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও অবস্থার অবনতি হতে থাকে স্ত্রী নদীর।

এ অবস্থায় পার্ক কর্তৃপক্ষ সবিস্তারে লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে এবং এরপর ২২ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি দফায় দফায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও উন্নতি ঘটেনি নদীর।

ক্ষতস্থান থেকে পানি ঝরা বন্ধ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আহত সিংহ নদীর চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন।

কমিটিতে ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধরকে প্রধান করা হয়। কমিটিতে সদস্য রয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুপন নন্দী, ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাদ জুলকার নাইনসহ পাঁচজন।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধর জানান, মেডিকেল বোর্ড গঠন করে দফায় দফায় চিকিৎসা সেবা প্রদানের পরও দিন দিন খাবার গ্রহণ একেবারেই কমিয়ে দেয় সিংহ নদী। অনবরত মুখ থেকে লালা বের হতে থাকে তার।

তিনি আরও জানান, এতদিন একটু একটু খাবার গ্রহণ করলেও সবশেষ ২৭ মার্চ থেকে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই সিংহটি জিহ্বা বের করে রাখে এবং মুখ থেকে লালা ঝরার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুজন বিশেষজ্ঞসহ মেডিকেল বোর্ডের অন্য সদস্যরাও ব্যাপক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু রাখলেও অবস্থার কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু দিন দিন আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে নদী।

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, মারামারিতে লিপ্ত হয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া নদীর উন্নত চিকিৎসায় ইতোমধ্যে দুবার মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী অসুস্থ নদীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে ২৮ মার্চ সিরাম ও রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে ১২ এপ্রিল ল্যাবের পরীক্ষার ফলাফল এবং মেডিকেল বোর্ডের মতে সিংহ নদীর শরীরে ভাইরাস ইনফেকশন হয়েছে।

পার্ক কর্মকর্তা আরও জানান, সিংহ নদীর বর্তমান অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। যে কোনো মুহূর্তে নদী মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই ধরা পড়া ভাইরাসের ব্যাপারে আরও বেশি নিশ্চিত হতে ফের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

পার্ক কর্মকর্তা মাজহার বলেন, ‘চিকিৎসা প্রদানসহ সিরাম ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য ইতোপূর্বে দুবার সিংহ নদীকে অবচেতন করা হয়। পহেলা এপ্রিল অবচেতন করার পর চেতনা ফিরতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বর্তমানে সিংহটির অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে।

২৭ মার্চ থেকে প্রাণীটি পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবারও গ্রহণ করেনি। তাই নতুন করে নমুনা সংগ্রহের জন্য অবচেতন করা হলে তা চরম ঝুঁকিপূর্ণ এবং চেতনা ফিরে না আসার আশঙ্কাই বেশি বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে অবহিত করা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এবং বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মারামারিতে লিপ্ত এবং আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে নদীর চিকিৎসায় দুবার মেডিকেল বোর্ড গঠনসহ দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে যাবতীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রক্তের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে একটি ভাইরাসও শনাক্ত হয়েছে শরীরে। তাই ভাইরাসটির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে ফের নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হবে। কিন্তু বর্তমানে সিংহ নদী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তৃতীয়বার ট্র্যাঙ্কুলাইজ করাটাও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। অবচেতন করা হলে এটির আর চেতনা ফিরে না আসারও আশঙ্কা রয়েছে। এর পরও সিংহ নদীর চিকিৎসায় কোনো হেরফের করা হচ্ছে না।’

এসএইচ-২৪/১৬/২২ (অনলাইন ডেস্ক)