দেরিতে কর্মস্থলে ঢুকলে বেতন কাটা

ঢাকায় শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকার একটি বিজয় সরণিতে বৃহস্পতিবার একটি গাড়ি উল্টে যাওয়ার পর সেটি সরিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লেগেছে।

ঢাকা শহরে যানজটের কারণে গাড়ি এমনিতেই যেন নড়ে না। যানজটে প্রতিদিন নাস্তানাবুদ হচ্ছেন শহরের বাসিন্দারা। ঢাকায় এখন গাড়ির গড় গতির চেয়ে হাঁটার গতিবেগ বেশি।

তার মধ্যেই ব্যস্ত একটি রাস্তায় অফিস যাওয়ার তাড়াহুড়োর সময়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তার প্রভাব পড়ে পুরো শহরে, যার চিত্র বৃহস্পতিবার দেখা গেছে পুরোমাত্রায়। ঢাকার ট্রাফিক অ্যালার্ট নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন পাতায় গেলে দেখা যাবে মানুষজনের বিরক্তি।

ঢাকা শহরের যানজট এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কত আগে বাড়ি থেকে বের হলে সময় মতো অফিসে পৌঁছানো যাবে সেটা বোঝার যেন আর কোন উপায় নেই।

এমন পরিস্থিতিতে অফিসে দেরিতে পৌঁছালে বেতন কাটার নানা নিয়ম বিভিন্ন কোম্পানিতে চালু রয়েছে। সেনিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি রয়েছে চাকরিদাতা এবং কর্মীদের।

ঢাকায় তৈরি পোশাক খাতে অ্যক্সেসরিজ সরবরাহ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তার বর্তমান কর্মস্থলে সপ্তাহে তিনদিন দেরিতে ঢুকলে একদিনের বেতন কেটে নেয়া হয়।

তিনি বলছেন, “বছর দুয়েক আগেও সোয়া এক ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হলে সময়মত অফিসে পৌঁছাতে পারতাম। এখন সেটা দেড় ঘণ্টার বেশি। আর কিছুকিছু দিন থাকে কোন কিছুই যেন কাজ করে না। এরকম পরিস্থিতিতে বেতন কেটে নেয়া হলে সারাদিন মন থেকে আর কাজ করতে পারি না। আজ বেতন পাবো না কিন্তু কাজ করছি।”

জান্নাতুল ফেরদৌস দুটি কারণে কিছুদিন হল তার আগের কর্মস্থল ছেড়েছেন।

“নতুন কর্মস্থলে আসতে সময় কম লাগে এটি অন্যতম কারণ তাতে দেরি হওয়ার ঝুঁকি কম। আগের অফিসে মিনিট প্রতি পাঁচ টাকা কেটে নেয়া হত। এটা আমি মানতে পারিনি। বেতন কাটার মতো এত বড় শাস্তি আর নেই কারণ আমরা বেঁচে থাকতে টাকার জন্যেই তো চাকরি করি।”

বেতন কাটার এই নিয়ম যুক্তিসঙ্গত মনে করেন না ঢাকার গুলশানে বছর তিনেক অফিস সহকারীর কাজ করছেন এমন একজন বলছেন, “আমার বাসা মিরপুর আর অফিস গুলশান দুই নম্বর। বাসা থেকে অফিসে যেতে সাধারণত এক ঘণ্টা লাগে। আমার অফিসের রিপোর্টিং টাইম সকাল আটটা। পনের মিনিট গ্রেস টাইম আছে। তবে আটটা বেজে ষোল মিনিটেও যদি ঢুকি এক মিনিটের জন্য এক ঘণ্টার বেতন কাটা হয়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হয়, বাকিটা ইতিহাস।”

তার ভাষায়, “ঢাকা শহর হচ্ছে খুবই জনবহুল এলাকা যেখানে মাত্রাতিরিক্ত যানজট। কখন বের হলে কত সময় লাগবে কেউ জানেনা। তবুও সবাই কিন্তু চেষ্টা করে সময়মত কর্মস্থলে পৌঁছাতে। কিন্তু যানজটের কারণে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেলে বেতন কাটার কি যুক্তি আছে আমার বুঝে আসেনা।”

বেসরকারি ও সরকারি পর্যায়ে নানা রকম নিয়ম চালু রয়েছে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের সাথে কথা বলে জানা গেছে তিন ধরনের নিয়ম প্রধানত চালু রয়েছে।

যেমন সপ্তাহে পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে তিনদিন কর্মস্থলে ঢোকার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১৫ মিনিটের বেশি দেরি করলে এক দিনের বেসিক বা মূল বেতন কেটে নেয়া হয়। কিছু কোম্পানি একদিনের পুরো বেতনটাই কেটে নেয়। তিনদিন যদি পরপর হয় তাহলে একদিনের বেতন কাটা হয়ে থাকে। কিছু কোম্পানিতে এক্ষেত্রে একদিনের ছুটি কেটে নেয়া হয়।

এগুলোই মূলত বেশি আরোপ করা হয়। তবে অনেক কোম্পানি ভিন্ন নিয়মও চালু করেছে যেমন আধাবেলা অথবা মিনিট প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণে বেতন কাটার নিয়ম।

আর সরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া দেরি করে অফিসে এলে প্রথমে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। কারণ যুক্তিসঙ্গত না হলে একদিনের মূল বেতন কেটে নেয়া যাবে। মাসে একাধিকবার দেরি করে এলে সর্বোচ্চ সাতদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেয়ার বিধান রয়েছে।

টি. কে. গ্রুপের প্রধান মানব সম্পদ নির্বাহী, অজেয় রোহিতাশ্ব আল্ কাযী বলছেন, “আপনি যদি সময় মতো কাজে না আসেন এবং সেজন্য সবসময় পার পেয়ে যান তাহলে আপনি অন্যদের জন্য একটা খারাপ উদাহরণ তৈরি করছেন। যেমন ধরুন একজন কর্মী খুবই ভাল কাজ করে কিন্তু নিয়মিত দেরিতে আসে। তার কাজ ভাল হওয়ার কারণে যদি আমি তাকে ছাড় দিয়ে দেই তাহলে অফিসের বাকিরাও একই জিনিস অনুসরণ করবে।”

এছাড়া দেরিতে কাজ শুরু হলে কাজ শেষ হবে দেরিতে। কর্মস্থলের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাবে। মি. আল্ কাযী বলছেন, “উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে যেমন গার্মেন্টস কারখানায় দশ মিনিট দেরি মানে পাঁচটা শার্ট কম সেলাই হওয়া। তারমানে অর্ডার দেরিতে শেষ হওয়া, শিপমেন্টে দেরি হওয়া। সময়ের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে রাজস্ব আয়ের।”

তার প্রতিষ্ঠানে মাসে একজন কর্মীর ৩৬০ মিনিটের বেশি দেরি হলে এক দিনের বেতন কেটে নেয়া হয়। তিনি জানিয়েছেন পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে শহরে কিছু ঘটেছে এবং সবার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি তারা বিবেচনা করেন। কোন জরুরী বিষয়ের ক্ষেত্রেও বিবেচনা করা হয়।

অফিসে দেরি করে ঢোকার সংস্কৃতি পছন্দ করে না কোন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে যেখানে দিনকে দিন আরো বেশি সময় হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হয়, তেমন শহরে বিকল্প কি কিছু আছে? একজন মানুষ আর কত আগে বের হতে পারেন?

ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক প্রতিষ্ঠান অবশ্য বেতন না কেটে ভিন্নভাবে দেরিতে ঢোকা কমানোর চেষ্টা করছে।

কনফিডেন্স গ্রুপ অফ কোম্পানিজ লিমিটেডের প্রধান মানবসম্পদ ও কর্পোরেট কমিউনিকেশন কর্মকর্তা মোহামম্দ তারিকুল ইসলাম বলছেন করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর তার প্রতিষ্ঠানে চালু হওয়া কিছু বিষয় তারা অব্যাহত রেখেছেন যা যানজটের দিনেও বেশ কাজে আসছে।

তিনি বলছেন, “প্যান্ডেমিকের সময়ে অফিসে সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা কর্মীদের সবার গাড়িতে আনা নেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছিলাম। সেটা আমরা এখনও চালু রেখেছি। কোম্পানির গাড়ি যদি এসে পৌছাতে দেরি করে তাতে কর্মীর তো কোন হাত নেই। আমরা আরো যেটা করেছি আমরা অফিসে ঢোকার সময় এগিয়ে নিয়ে এসেছি। দেখবেন ঢাকায় নটার পরে একটা মারাত্মক চাপ তৈরি হয় কারণ অনেক কর্পোরেট অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দশটায় শুরু হয়। এতে আমাদের অনেক লাভ হয়েছে।”

মহামারির সময়ে যেভাবে বাড়িতে বসে কাজ করতে হয়েছে সেরকম সপ্তাহে একদিন বাড়িতে কাজ করার ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা। ঢাকায় এখন বহু কোম্পানি নিজস্ব পরিবহনে কর্মীদের আনা নেয়া করছে। রাস্তায় নেমে বাহন খোঁজার জন্যে নষ্ট হওয়া সময়টাও বেঁচে যাচ্ছে।

ঢাকায় এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে কাজে ঢুকতে দেরি করলে পাঁচশ টাকা নিয়ে নেন লাইন ম্যানেজার। কিন্তু টাকাটা দিয়ে সহকর্মীদের জন্য পার্টি আয়োজন করা হয়, কিছু একটা কিনে আনা হয় তাদের খাওয়ার জন্য।

এসএইচ-১০/২০/২২ (শাহনাজ পারভীন, বিবিসি)