আওয়ামী লীগের ভিতরে ‘এমপি লীগ’

শাসক দল আওয়ামী লীগে এখন ‘এমপি লীগ’ই বড় হয়ে উঠছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মূল দলের নেতা-কর্মীরা কোনঠাসা। দাপদ দেখাচ্ছেন এমপি ও এমপির অনুসারীরা।

ফলে তৃণমূলে কমিটি, টেন্ডার, উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা বিষয় নিয়ে এমপিদের সাথে নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। আর এই দ্বন্দ্ব নিয়ে কেন্দ্রও চিন্তিত।

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম রমজান। তিনি এখন হাইব্রিড সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, দূরে সরে গেছেন। কেন এই পরিস্থিতি জানতে চাইলে বলেন,” এমপি সাহেবরা পকেট কমিটি তৈরি করেছেন। তারা আওয়ামী লীগের ভিতরে এমপি লীগ করেছেন। ফলে মূল আওয়ামী লীগ কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে সদরের এমপি সাহেব তার একটি বলয় তৈরি করেছেন হাইব্রিড ও বহিরগতদের দিয়ে। তাদের মাধ্যমেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।”

এটা কেন প্রয়োজন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন,”দলে অবস্থান শক্ত না থাকার পরও স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটিতে আধিপত্য, উন্নয়নমূলক কাজে আধিপত্য আর দলের মধ্যে প্রভাব তৈরির জন্য তারা এটা করেন। তারা আসলে সামনের নির্বাচনে যাতে আবারো মনোনয়ন পান সেজন্য এরকম করছেন।”

অনেক এমপিরই এখন ইমেজ খারাপ। তারা সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। দলেও তাদের বড় পদ নেই। কিন্তু এই প্রভাব বলয় তৈরি করে, আওয়ামী লীগের মধ্যে এমপি লীগ তৈরি করে টিকে থাকতে চাইছেন বলে জানান তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন,”আমার জেলায় কেউ নতুন করে আওয়ামী লীগে এসে এমপি হয়েছেন। কেউ তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ রাখেন না। কিন্তু প্রভাব ধরে রাখতে চান। সে কারণেই তাদের আলাদা অনুসারী গ্রুপ হয়েছে। তারা চায় বিভিন্ন কমিটিতে তাদের লোকজন ঢুকাতে। বিভিন্ন কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করতে। ফলে সমস্যা হচ্ছে।”

তার কথা,”আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি ক্লাস ও গণতান্ত্রিক রাজনৈকি দল। এখানে নতুন লোক তো আসবেই। তারা এসেই চেষ্টা করছে নতুন বলয় তৈরি করতে। এমপি সাহেবরাও তাদের অবস্থান শক্ত করতে তাদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি করছেন। তারা দল ও স্থানীয় নানা কাজে তাদের প্রভাব সৃষ্টির জন্য এটা করেন।

জেলা পর্যায়ের এই দুইজন নেতা জানান,”এই পরিস্থিতি সবখানে না হলেও অনেক জেলায়ই সমস্যা হচ্ছে। এটা কেন্দ্রীয় নেতারাও জানেন। তাই কেন্দ্র থেকে নতুন কমিটি গঠনে হাইব্রিড, সদ্য আগত, আমদানিকৃতদের না রাখার জন্য বলা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১১ সালের পর যারা আওয়ামী লীগে এসেছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”

গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেকর্ড সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর নেপথ্যে ছিলেন এমপিরা। উপজেলা ও পৌর নির্বাচনেও তাই। তাদের অনুসারীরা যেখানেই নির্বচনে মনোনয়ন পাননি সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়েছেন তারা। তাই বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না থাকার পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতার রেকর্ড হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের ৪৫টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। যা এমপি লীগের দৌরাত্মেরই ফল বলে ধারণা করা হয়। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগে ৯৬ টি এবং ২০২০ সালে ৭৪টি এই ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ কুমিল্লা-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের হাতে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের মার খাওয়ার ঘটনা তৃণমূলের কমিটিকে কেন্দ্র করেই। বরগুণা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন তার বিরোধীদের পিটানোতে সিদ্ধহস্ত বলে এরমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছেন।

শফিকুল ইসলাম রমজান বলেন, তৃণমূলের নেতা কর্মীদের এরকম পিটানো বা মারধোরের অনেক ঘটনা আছে। সব তো আর খবর হয়না। আমার এলকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘ দিন ধরে এমপি গ্রুপের নির্যাতনের শিকার। তারপরও আমি ধৈর্য ধরে আছি।”

কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমানত হোসেন খান অভিযোগ করেন,”আমার এলাকার এমপি আমাকে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ থেকেও বাদ দিয়েছেন। আর উপজেলার সব কমিটি তার লোকজন দিয়ে তৈরি করেছেন। আমাকে কোনো কাজই করতে দেন না। যেখানেই কিছু করতে যাই সেখানেই তার লোকজন দিয়ে বাধা দেন। এই পরিস্থিতি কেন্দ্রকে জানালে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এমপিকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও তিনি ধামছেন না। ৭৫-এর পর যে নেতারা কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধরে রেখেছিলেন তাদের অপমান করা হচ্ছে।”

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে কমপক্ষে ৪০ জেলায়ই কমবেশি পরিস্থিতি খারাপ বলে বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়। ওই সব জেলায় কমিটি গঠনসহ নানা বিষয়ে এমপি গ্রুপের আধিপত্য তৈরি হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ চাইছে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে। এজন্য দেশের আট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা এরইমধ্যে কেন্দ্রে পরিস্থিতি জানিয়ে প্রতিবেদনও দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ চাইছে তৃণমৃলে দল এবং এমপিদের মধ্যে একটি ভারসাম্য অবস্থা তৈরি করতে। যেসব এমপিরা এরকম মারামারি ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন তাদের একটি তালিকাও করা হয়েছে। আগামী ২১ জুলাই তাদের নিয়ে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন,”এটা বড় কোনো সংকট বা ঘটনা নয়। কিছু কিছু এলাকায় সমস্যা হচ্ছে সেগুলো আমরা দেখছি। আর কেউ দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন,”এমপি সাহেবরা অনেকে দলের বড় পদে না থাকলেও তারা তার এলাকার এবং দলের অভিভাবক, তাদের কাছে সবাই যাবেন। তারা যদি সবাইকে সহায়তা করেন সেটা তো স্বাভাবিক। এটার মধ্যে প্রভাব বিস্তার বা বলয় তৈরি করার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।”

এসএইচ-১৫/১৮/২২ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)