কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী

কেউ কেউ বলছেন, নানামুখী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী৷ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ভিন্ন নামে নিবন্ধনের চেষ্টাও করছে৷

কেউ কেউ বলছেন, নানামুখী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী৷ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ভিন্ন নামে নিবন্ধনের চেষ্টাও করছে৷ সর্বশেষ বুধবার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে একটি নতুন দল আবেদন করেছে৷ এই দলটির সঙ্গে যুক্ত সবাই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ তবে এই মুহূর্তে কোনো পক্ষই তা স্বীকার বা দাবি করছেন না৷

নতুন এই রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম চান ও জেনারেল সেক্রেটারি মুহা. নিজামুল হক নাঈম৷ এর মধ্যে আনোয়ার ইসলাম চান জামায়াতের ঢাকার ডেমরা থানার আমির আর নিজামুল হক নাঈম জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য৷ জামায়াতের সঙ্গে নতুন এই দলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে নিজামুল হক নাঈম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটা দল৷

বাংলাদেশের সংবিধান মেনেই আমরা রাজনীতিতে এসেছি৷ সংবিধানের প্রতিটি শব্দকেই আমরা সম্মান করি এবং সেটাকে লালন করেই আমরা রাজনীতি করি৷” জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন কিনা জানতে চাইলে জনাব নাঈম বলেন, “অনেকদিন আগে শিবিরের রাজনীতি করেছি৷ সেখানে পদত্যাগের কোন ব্যবস্থা নেই৷ আর অনেকেই দল পরিবর্তন করেন, এটা তো করতেই পারেন৷ আমরা এখন নতুন রাজনৈতিক দল নিয়েই ভাবছি, সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলব৷”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট৷ এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন৷ নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা৷ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির অনেক সিনিয়র নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে৷

জামায়াতের রাজনীতিতে আগে সক্রিয় ছিলেন, বর্তমানে নিষ্ক্রিয় এমন একজন নেতা ডয়চে ভেলেকে বলেন, “রাজনীতি ছেড়ে দিলেও দলটির কর্মকাণ্ডে নিয়মিত নজর রাখি৷ আসলে জামায়াতের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে৷ সামনে নির্বাচন৷ গত নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে ‘প্রতারণা করেছে’ বিএনপি৷ কারণ আলোচনায় জামায়াতকে ৩২টি আসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিয়েছে ২৫টি৷ এরপর আবার প্রতীক দিয়েছে ২২টি আসনে৷ নিজেদের কোন প্লাটফরম না থাকায় বিএনপির সব সিদ্ধান্ত তাদের মেনে নিতে হয়েছে৷

ফলে এবারের নির্বাচনের আগে জামায়াত নিজেদের একটি দল চায়৷ প্রথম টার্গেট আইনি লড়াইয়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফেরত পাওয়া৷ সেটা না হলে ভিন্ন নামে নিবন্ধনের চেষ্টা করা৷ তাতেও ব্যর্থ হলে ছোট কোন নিবন্ধিত দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, সেই দলের প্রার্থী হবেন জামায়াত নেতারা৷” এর মধ্যে শেষ প্রক্রিয়াটি অনেক দূর এগিয়েছে৷ বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির বেশ কিছু পদ তারা দখলে নিয়েছেন বলেও দাবি সাবেক এই নেতার৷ এই দলের মহাসচিব আমিনুর রহমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নেতা ছিলেন৷

তবে জামায়াতের সাবেক এই নেতার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম৷ তিনি বলেন, “আমিনুর রহমান শিবিরের রাজনীতি করেছেন এটা সত্যি৷ কিন্তু জামায়াতের রাজনীতি তিনি পছন্দ করেননি৷ ফলে ১৪ বছর রাজনীতির বাইরে থেকে কল্যাণ পার্টিতে যোগদান করেছেন৷ এখানে জামায়াতের পূর্নবাসনের কোন সুযোগ নেই৷ আমরা কোন রাজনৈতিক দলের দায় বহন করব না৷ আমাদের এখানকার অধিকাংশ নেতাকর্মী তরুণ৷ তবে এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি) থেকে চার জন এখানে যোগদান করেছেন৷” জামায়াত ভেঙেই তো এবি পার্টি হয়েছিল, তারাও তো সাবেক জামায়াত? জবাবে জনাব ইবরাহিম বলেন, “জামায়াত ভেঙে এবি পার্টি হয়েছিল সত্যি৷ কিন্তু সেখানে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তারা সবাই তো জামায়াতের লোক না৷ বাইরে থেকেও তো অনেকে এসেছিলেন৷”

২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে সংগঠনের মজলিসে শূরার সদস্যদের বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা পাঠানো হয়৷ এরপর শূরা সদস্যদের অভিমতের ভিত্তিতেই নতুন নামে দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়৷ এ নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়৷ অবশ্য ওই কমিটি গঠনের তথ্য গোপন রাখার অভিযোগে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন লন্ডনে অবস্থানরত ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক৷ এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু৷

এরপরই জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ‘জনআকাঙ্খার বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও মুজিবুর রহমান মঞ্জু৷ পরে ২০২০ সালের মে মাসে তারা ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ বা ‘এবি পার্টি’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷ এ দলটিও এবার নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে৷ কমিশনে আবেদন জমা দেওয়া জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে আরেকটি দলেও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা রয়েছেন৷ এছাড়া নতুন করে জমা দেওয়া হয়েছে বিডিপি নামে৷

নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কী এসব রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে? জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম  বলেন, “নতুন দল করলে জামায়াত ঘোষণা দিয়েই করত৷ জামায়াত নিষিদ্ধ দল নয় এবং দলের নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে করা মামলা এখনো সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন৷ এ অবস্থায় অনেকে না বুঝে নতুন দলটি জামায়াতের বলে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালাচ্ছে৷ এই দলের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই৷ আমরা কিছু করলে সবাইকে জানিয়েই করব৷”

ভিন্ন নামে আবেদনের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন পেতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরও৷ বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “দলের কেউ যুদ্ধাপরাধী না হলে এবং তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে এবং সব শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে বাধা নেই৷”

তবে কোন ফরমেটেই জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন লেখক, সাংবাদিক শাহারিয়ার কবীর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “কালসাপ খোলস বদলালে কী তার স্বভাব বদলায়? জামায়াতও তেমন৷ এবারও তারা পুরনো কৌশল নিয়েছে৷ ১৯৭২ সালে তো জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল৷ কিন্তু ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলে তারা ‘ইসলামী ডেকক্রেটিক লীগ’ নামে রাজনীতি শুরু করে৷ পরে আবার জামায়াত নামে ফিরে আসে৷ ফলে এবারও সেই কৌশল নিয়েছে৷ যতদিন তারা মওদুদীর আদর্শ থেকে সরে না আসবে, ধর্মের নামে সন্ত্রাসের পথ থেকে সরে না আসবে ততদিন তারা বদলাবে না৷”

ভিন্ন নামে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পেতে জামায়াতের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, “কোন ফরমেটেই তাদের নিবন্ধন দেওয়া উচিৎ হবে না৷ কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মেনে রাজনীতি করতে আসেন তাদের সেই সুযোগ পাওয়া উচিৎ৷ কিন্তু জামায়াতের নেতারা তো মুক্তিযুদ্ধকেই স্বীকার করেন না৷ তারা কী বলেছে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের শাস্তি হয়েছে এটা ঠিক আছে৷ সেটা তো স্বীকার করে না৷ ফলে তাদের রাজনীতিতে সুযোগ পাওয়া উচিৎ নয়৷”

জামায়াতের এই উদ্যোগকে বিএনপি কীভাবে দেখছে, জানতে চাইলে সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ এমপি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মিডিয়াতে কিছু বিষয় এসেছে৷ সেটা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা উচিৎ নয়৷ তবে বাংলাদেশের সংবিধান মেনে কেউ যদি রাজনীতি করতে চান সেটার মধ্যে তো দোষের কিছু নেই৷ তাদের সেই সুযোগ পাওয়া উচিৎ৷”

এসএইচ-০৬/২৭/২২ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)