জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হওয়ার পর সপ্তাহজুড়ে যা করেছিলেন

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সে বছর নভেম্বরের প্রথম দশদিনের মধ্যেই দুইটি বড় অভ্যুত্থান ঘটে। সাথে একাধিক অভ্যুত্থান চেষ্টাও ছিল, ফলে পুরো নভেম্বর মাসই ছিল উত্তাল।

সেনানিবাসের ভেতরে এবং বাইরে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক ঘটনা ঘটছিল।

রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন, সৈনিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং বিপ্লবী সৈনিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা এমন বহু ঘটনা ঘটেছিল নভেম্বর মাসেই।

পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে ওই সময় কর্মরত অফিসারদের লেখা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে সেই অস্থির সময়কার ঘটনা প্রবাহ।

ওই সব বইয়ের সূত্রে বোঝা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান মূলত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের পরিকল্পনায় হলেও তার সুফল পেয়েছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।

সেটি ছিল ওই বছর ঢাকা সেনানিবাসে তিন মাসের ব্যবধানে ঘটা তৃতীয় অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর মধ্যে ওই অভ্যুত্থান ঘটাতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছিল জাসদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।

কিন্তু নভেম্বরের তিন তারিখে খালেদ মোশারফ পাল্টা অভ্যুত্থান করেন। তিনি নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান চিফ অব মিলিটারি স্টাফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়।

এরপর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে, এবং ৬ই নভেম্বর মধ্যরাতে তারা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।

মুক্তির পর রেকর্ড করা এক রেডিও ভাষণ যেটি ৭ই নভেম্বর সকালে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়েছিল, তাতে জেনারেল জিয়া বলেছিলেন তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন।

‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল এমএ হামিদ লিখেছেন, ওই ভাষণে জেনারেল জিয়া বলেন, ‘দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে এই কাজ করেছেন’ এবং তিনি ‘সবাইকে শান্ত থাকা’র আহ্বান জানান।

জিয়াউর রহমানের ওই রেডিও ভাষণের পর অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর ভূমিকা চাপা পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্মে যে, এটি পুরোপুরিই জিয়াউর রহমানের অভ্যুত্থান।

এভাবেই ৭ই নভেম্বরে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান, এবং ওইদিনই বঙ্গভবনের বদলে সারাদেশের দৃষ্টি ঘুরে যায় ক্যান্টনমেন্টের দিকে, বিশেষ করে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিস-ব্যারাকের দিকে।

কারণ জিয়াউর রহমানের অপারেশনাল হেড কোয়ার্টার তখন ছিল টু-ফিল্ড ব্যারাক।

কিন্তু ৭ই নভেম্বরের সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল তাহেরের মধ্যে মতানৈক্য চরমে পৌঁছে, কারণ জিয়াউর রহমান সৈনিকদের দেয়া সব দাবি মেনে নিতে চাইছিলেন না।

সৈনিকেরা তখন অফিসারদের বিরুদ্ধে পাল্টা-বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়।

ওই রাতে বিপ্লবী সৈনিকদের গুলিতে ঢাকা সেনানিবাসে ১২জন অফিসার নিহত হন। আক্রান্ত হয়েও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান কয়েকজন।

এরপরের কয়েকদিন সেনানিবাসের ভেতরে এবং বাইরে ছিল খুবই ঘটনাবহুল।

অভ্যুত্থানের মূল কেন্দ্র ঢাকা সেনানিবাস হওয়ায় পরের কয়েকদিন সেনানিবাসের ভেতরে ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ। তবে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সেই একই অবস্থা ছিল না।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ জাসদের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেই সময় আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি সিপিবি ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল, যাদের মধ্যে ইসলামপন্থী ও চীনপন্থি বাম দল সবাই এই অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।

পঁচাত্তরের ১৫ই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবং সিপিবির বড় অংশের নেতৃবৃন্দ তখন আত্মগোপনে ছিলেন বলে বলছেন মি. আহমদ।

যে কারণে ঢাকায় অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ হয়নি।

তবে সেনানিবাসের ভেতরের পরিস্থিতি ছিল থমথমে।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ‘মহান সিপাহী বিপ্লব’ ৮ই নভেম্বর ভিন্ন আকার ধারণ করে।

জেনারেল জিয়ার সাথে এদিন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি নিয়ে জাসদ নেতাদের দফায় দফায় বৈঠক হয় বলে উল্লেখ করেছেন লে. কর্নেল হামিদ।

তিনি তখন সিনিয়র জেসিও অর্থাৎ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের আলোচনা চালাচ্ছিলেন, সৈনিকদের কাছে আবেদন করছিলেন যাতে কেউ আর রক্তপাত না ঘটায়। সেই সাথে জেনারেল জিয়া সারাদিন ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটে ঘুরে সৈনিকদের অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অফিসারদের অধিকাংশই আগের রাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পরেরদিন মানে ৮ই নভেম্বরও সে অবস্থা চলেছে সারাদিন।

সাবেক কূটনীতিক আনোয়ার উল আলম, যিনি রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক ছিলেন তার ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বইয়ে লিখেছেন, ৯ই নভেম্বর থেকে জিয়াউর রহমান হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন সেনানিবাসে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করতে শুরু করেন।

এর আগে ওই দিন মানে নয় তারিখ সকালে আর্মি হেডকোয়ার্টারে মিটিং ডাকেন জেনারেল জিয়া, যার মূল লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরিকল্পনা করা।

তাতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা এবং এর আশেপাশের সেনানিবাসগুলো থেকে ৩০ জনের মত সামরিক কর্মকর্তা।

তবে ওইদিন ঢাকা সেনানিবাস কার্যত অচল ছিল, কোন কাজকর্ম হয়নি। কিন্তু ঢাকা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।

বিকেলে জাসদ একটি বিজয় মিছিল বের করে বায়তুল মোকাররমে। সেটিতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, যদিও তাতে কেউ আহত হয়নি।

এর মধ্যে ৯ই নভেম্বর সিএমএইচ থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের লাশ সেনানিবাস গোরস্থানে দাফন করা হয়।

ইতিহাসবিদ মি. আহমদ বলেছেন, অভ্যুত্থানের পরের দুই-তিনদিনের মধ্যে জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

কিন্তু বিদ্রোহী সৈনিকদের শান্ত করার জন্য ১০ই নভেম্বর একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল।

ওইদিন জেনারেল জিয়াউর রহমান টু-ফিল্ড ব্যারাক থেকে সেনাসদরে অফিস করতে শুরু করেন, এবং সেখান থেকে সৈনিকদের কাছ থেকে অস্ত্র ফেরত আনা এবং ‘কমান্ড কন্ট্রোল’ ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করতে থাকেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক’ নামক বইয়ে লিখেছেন, সেনাসদরে জেনারেল জিয়া ক্ষুব্ধ সৈনিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন।

কিন্তু তাদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে “এক পর্যায়ে তার কোমরের আর্মি বেল্ট খুলে মাটিতে ছুঁড়ে দেন এবং বলেন, এত দাবিদাওয়া উঠলে আমি আর এ আর্মির চিফ থাকতে চাই না।”

এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।

সৈনিকদের দাবি ধাপে ধাপে মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়।

কিন্তু এরই মধ্যে কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্ব বদলে দেয়া হয় অনেকের, কয়েকজনকে গৃহবন্দি করা হয়।

বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আদেশ দেয়া হয় কর্মকর্তাদের।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, নভেম্বরের ১৪/১৫ তারিখের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পরিস্থিতি প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

সিপাহি বিদ্রোহের এক পক্ষকাল অর্থাৎ দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে বলে লিখেছেন লে. কর্নেল হামিদ।

সৈনিকেরা ব্যারাকে ফিরে আসে, লুট করা অস্ত্র জমা দেয় তারা। বিপ্লবী সিপাহিরা পালিয়ে যায়।

তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার সাথে সাথেই অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হয়। সৈনিকদের বহিষ্কার, বদলি এবং বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

সিগন্যাল রেজিমেন্টকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট, যে ইউনিটের অধীনে ট্যাঙ্ক থাকে, সেটিকে ঢাকা থেকে বগুড়া পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর্টিলারিসহ কয়েকটি ইউনিটের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এসবের মধ্যেই অভ্যুত্থানে জড়িত সৈনিক ও কর্মকর্তাদের সামরিক আদালতে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। তাতে কর্নেল তাহেরসহ অনেকের ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।

কর্নেল তাহেরকে ১৯৭৫ সালের ২৪শে নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, সেটি ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে প্রথম কোন অফিসারের ফাঁসির ঘটনা।

পঁচাত্তর পরবর্তী তিন বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও বগুড়াসহ বিভিন্ন সেনানিবাসে ছোট-বড় মিলে ১৮টি সেনা-বিদ্রোহ ঘটেছিল।

এসএইচ-০১/০৮/২২ (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি)