রিজার্ভ ওঠানামা কি খুবই অস্বাভাবিক?

বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে: বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট কি না। এ ছাড়া সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় নিয়েও রয়েছে নানাজনের নানা মত।

সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া সবশেষ তথ্যানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (আকু) ১৩৫ কোটি ডলার পরিশোধ ও আমদানি বকেয়া ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার মেটানোর পর বর্তমান রিজার্ভ এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বিগত সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সে সময়ে রিজার্ভের অঙ্ক কত ছিল তা জানার উপায় নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্রে স্বাধীনতার প্রথম দশকে রিজার্ভের বিষয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।

রিজার্ভ নিয়ে প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তা ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের। তখন ব্যাংকে রিজার্ভের অঙ্ক ছিল মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার। তাই নথিপত্র যাচাইয়ের ভিত্তিতে বলা যায়, এ অঙ্কের সামান্য অর্থ নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের রিজার্ভের যাত্রা।

এক লাফে বাংলাদেশের রিজার্ভ আকাশচুম্বী না হলেও, দ্রুত বাড়ছিল রিজার্ভের অঙ্ক। পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে ব্যাংকে রিজার্ভের অঙ্ক দাঁড়ায় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

প্রথমবারের মতো, ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ঘর অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে, যা ছিল বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক।

১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষেই রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে।

কিন্তু ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল।

২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর আর বাংলাদেশের রিজার্ভ কখনোই ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামেনি।

২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এ সময়টা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য উত্থানের গল্প।

২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্ক ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু চলতি বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক পরিস্থিতি নেতিবাচক রূপ ধারণ করে। এতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাড়াতে থাকে সুদের হার, ফলে ডলারের বাজারে দেখা দেয় অস্থিরতা, জ্বালানি বাজারে শুরু হয় সংকট, কমে আসে উৎপাদন, ভেঙে পড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ও বেড়ে যায় জাহাজ ভাড়া তথা আমদানি ব্যয়। এসব কারণে চলতি বছর দেশের রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা দুশ্চিন্তার বিষয়।

রিজার্ভ কমায় বাংলাদেশের করণীয় কী, কীভাবে বাংলাদেশ সংকট সামাল দিতে পারে–এসব নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হানের সঙ্গে। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, গত ১০-১২ বছরের রিজার্ভের চিত্র থেকে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়েছে। গত এক দশকেও বাংলাদেশ যা দেখেনি এই প্রথম তা দেখছে: রিজার্ভ কমছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসেই রিজার্ভ কমছে। যখন অর্থনীতি স্বাভাবিক থাকে, তখন রিজার্ভ বাড়া-কমা নিয়ে এতটা চিন্তিত না হলেও চলে। তবে বর্তমানে অর্থনীতি একটি দোদুল্যমান সময় পার করছে। এ অবস্থায় রিজার্ভের ব্যাপারটা গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘সংকটকালীন রিজার্ভের গুরুত্ব অনেক বেশি। বৈশ্বিক সংকটে চাইলেই অন্য মাধ্যম থেকে অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে না। আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে দরকষাকষিটা কত কঠিন হচ্ছে। সবকিছু মিলে গেলেও আগামী মাসের মধ্যে হাতে টাকা পাওয়া যাবে–বিষয়টা এমন নয়। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের যে রিজার্ভ ছিল, তা দিয়ে ছয়-সাত মাসের আমদানি ব্যয় সামাল দেয়া যেত। কিন্তু এখন ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে আমদানি ব্যয় সামাল দেয়া যাবে তিন-চার মাসের।’

তিনি বলেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসেই দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়ছে। মূলত সঞ্চয় থেকে খরচ করতে গিয়ে একধরনের রিজার্ভ ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে সেলিম রায়হান বলেন, ‘রিজার্ভ কমে যাওয়া উদ্বেগের। তবে আমি মনে করি না, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়ে যাবে। শ্রীলঙ্কা খাদের কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ সংকটের মধ্যে আছে, তবে শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত সংকট সামাল দিতে দ্রুত কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া।’

সংকট সামাল দিতে উদ্যোগের বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমাদের এক্সচেঞ্জ রেটের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। একেক জায়গায় একেক রকমের এক্সচেঞ্জ রেট। আমদানিতে একধরনের, রেমিট্যান্সে আরেক ধরনের, ব্যাংক ব্যবস্থায় আবার আরেক রকমের। এমন বহুমুখী এক্সচেঞ্জ রেট দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদের। এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে এক অর্থে ছেলেখেলা করা হচ্ছে। এটি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। অন্যদিকে ব্যাংকের জামানত ও ঋণ সুদের হারের নয়-ছয় থেকে সরে আসতে হবে। এভাবে সুদহার বেঁধে রাখলে দেশের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়বে।’ দ্রুত এ দুটি সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে রিজার্ভে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

গত এক দশক আগেও বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১০-১২ বিলিয়ন ডলার। সে সময় এতটা অস্থিরতা দেখা না গেলেও ৩৪ বিলিয়ন রিজার্ভ নিয়ে কেন অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক দশক আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল না, সরবরাহ ব্যবস্থার বেহাল দশাও ছিল না। মূল সমস্যা বৈশ্বিক সংকট নিয়ে। সংকটের মধ্যে সঞ্চয় কমতে থাকলে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।

এদিকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি একধরনের চাপে আছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়মিত করতে পারলে উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

এসএইচ-০৩/০৮/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)