একজন সাংবাদিকের জবানবন্দিতে সেই নূর হোসেন

১০ই নভেম্বর, ১৯৮৭ সাল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগ এবং গণতন্ত্রের দাবিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সচিবালয় অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিরোধী দলগুলো। অবরুদ্ধ নগরীতে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল এক তরুণ, নূর হোসেন। তার বুকে পিঠে স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের দাবিতে লেখা শ্লোগান। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তোলা নূর হোসেনের ছবি পরবর্তীকালে হয়ে উঠে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন নিজের শরীরকে জীবন্ত পোস্টার করে তুলেছিলেন? কে তার শরীরে লিখে দিয়েছিল এই শ্লোগান?

গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে সেদিন ঢাকার শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমের যে সেলে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে তখন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে আটক ছিলেন আরও অনেকে।

৩৩ বছর পর নূর হোসেনের পরিবার, বন্ধু, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী এবং সহবন্দীদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ:

ঝাঁকড়া চুলের শ্যামলা রঙের ছেলেটিকে আমরা যখন দেখি, তখন তার দেহ রক্তাক্ত। কিন্তু তার শরীরে সাদা রঙে লেখা শ্লোগান তখনো জ্বলজ্বল করছে। আমরা তখনো জানি না, ছেলেটি কে, কী তার নাম।

শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ছোট্ট এক সেলে পড়েছিল কয়েকটি রক্তাক্ত দেহ।

আমরা ছিলাম ঠিক পাশের আরেকটি সেলে। শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমের সেই কয়েদখানা তখন ক্রমশ ভরে উঠছে রাজনৈতিক বন্দীতে। আমার বয়স তখন ১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

পাশের সেলটি থেকে বহুক্ষণ আহত মানুষের মরণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে আমরা একটু পরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম।

ততক্ষণে সেখানে পড়ে থাকা দেহগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই তারা জীবিত না মৃত। ছোট্ট সেলটিতে যেভাবে তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল না শরীরের কোন অংশটি কার। একজনের শরীরের নীচে চাপা পড়েছে আরেকজনের শরীর।

সেই বীভৎস দৃশ্যে বেশিক্ষণ চোখ রাখা মুশকিল।

কিন্তু একই সঙ্গে একজনের শরীরের উর্ধাঙ্গে সাদা রঙে লেখা শ্লোগান এক তীব্র ধাক্কা দিয়েছিল আমাদের।

আমরা জানতাম না, এই তরুণের নাম নূর হোসেন।

বুকে-পিঠে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামা নূর হোসেনের যে ছবিটি চিরকালের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেই ছবিটি পরে বহু শতবার দেখেছি আমি।

কয়েকটা প্রশ্ন বারে বারে আমার মনে জেগেছে: ঢাকার এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন শরীরে এই শ্লোগান লিখেছিল? কে তাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তার শরীরে কে লিখে দিয়েছিল এই শ্লোগান?

তেত্রিশ বছর পর এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যান কিছু নতুন সূত্র।

ঢাকার অফিস পাড়া মতিঝিল আর বঙ্গভবনকে ভাগ করে রেখেছে যে উঁচু প্রাচীর, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। সেখানে পপুলার আর্ট বলে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ইকরাম হোসেন। তার বয়স তখন ১৮।

ছোটবেলা থেকেই ইকরামের ছিল আঁকাআঁকির শখ। সেখান থেকে হয়ে গেলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট।

ইকরাম হোসেনের কথা আমি প্রথম জানতে পারি নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেনের কাছে। তিনিই আমাকে টেলিফোনে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন তার সঙ্গে।

“আমি মূলত সাইনবোর্ড, ব্যানার এসব লেখার কাজ করতাম। মতিঝিলে বিসিআইসি ভবনের কাছে ছিল আমাদের দোকান,” বলছিলেন ইকরাম হোসেন।

ইকরাম হোসেন তখন থাকেন মতিঝিলের কাছেই বঙ্গভবনে স্টাফ কোয়ার্টারে। তাঁর বড় ভাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপরাশি। তিনি বড় ভাইয়ের বাসায় থাকেন, আর মতিঝিলে এই দোকান চালান।

৯ই নভেম্বর, ১৯৮৭। ঢাকা শহর তখন অবরুদ্ধ, সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। পরদিন ঢাকায় সচিবালয় অবরোধ। পরিস্থিতি ভালো নয়। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বিকেল পাঁচটাতেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইকরাম।

কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটাতেই তার কাছে এসে হাজির ছেলেটি। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।

ছেলেটির সঙ্গে সেরকম কথা হয়নি কখনো ইকরামের, তবে মুখ চেনা। নাম তার নূর হোসেন।

“নূর হোসেন যখন আসলো, আমি তখন আমার কাজ শেষ করছি। নূর হোসেন আমাকে বললো, ইকরাম ভাই, আপনি এমন এক জায়গায় আজকে লিখবেন, যেখানে জীবনেও লেখেন নাই।”

ইকরাম হোসেনের শিল্পী মনে কৌতুহল জাগলো। কী এমন লেখা, যা জীবনে লেখেননি?

অফিস পাড়ায় তখন শীতের সন্ধ্যা নামছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ইকরামকে নিয়ে নূর হোসেন ঢুকে গেলেন এক ছোট্ট গলিতে। তারপর যা করলেন, তাতে হতভম্ব হয়ে গেলেন ইকরাম হোসেন। নূর হোসেন তার গায়ের জামা খুলে ফেললেন এক ঝটকায়।

‍”আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি জামা খুললেন কেন। নূর হোসেন আমাকে বললেন, ইকরাম ভাই, আপনি আমার বুকের এখানে লিখবেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, আর পিঠে লিখবেন , ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো জীবনেও কোন মানুষের গায়ে লিখিনি। আমি কাউকে কখনো মানুষের গায়ে লিখতে দেখিনি।”

“আমি একটু ভয় পেলাম। আমার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের চাপরাশি। আমি থাকি বঙ্গভবনের কোয়ার্টারে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে তো আমি এরকম একটা জিনিস লিখতে পারি না। আমি বললাম, না, এটা আমি লিখতে পারবো না। আপনি এটা লিখে বাইরে গেলে পুলিশের মার খাবেন। তারপর জেলে যাবেন। আপনি মরেও যেতে পারেন।”

কিন্তু নূর হোসেন ছিলেন নাছোড়বান্দা।

“নূর হোসেন আমাকে বলেছিল, ইকরাম ভাই আমি একা না, আরও একশো জনের গায়ে এটা লেখা থাকবে। আমরা সবাই কাল এক সঙ্গে মিছিল করবো।”

একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ইকরাম হোসেন এরপর যা লিখে দিলেন, তা এখন ইতিহাস।

কী লিখতে হবে তা নূর হোসেন নিজেই চক দিয়ে প্রথমে দেয়ালে লিখেছিলেন। সেই লেখা দেখে নূর হোসেনের বুকে আর পিঠে তিনি সাদা রঙে একেঁ দিলেন সেই বিখ্যাত শ্লোগান: স্বৈরাচার নীপাত যাক।। গণতন্ত্র মুক্তি পাক।। যেভাবে ভুল বানানে নূর হোসেন চক দিয়ে দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে।

তিনি শ্লোগানটি লিখেছিলেন এনামেল পেইন্ট দিয়ে। বুকে-পিঠে দুদিকেই শ্লোগান লিখে শেষে দুটি দাড়ি দিয়েছিলেন।

“এটা আমি করেছিলাম, একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। যেহেতু নূর হোসেন বলেছিল আরও একশো জনের গায়ে শ্লোগান লেখা থাকবে, তার মধ্যে আমার লেখা শ্লোগান যেন আলাদা করে চেনা যায়। কিন্তু নূর হোসেন আমাকে আসলে মিথ্যে কথা বলেছিল। সে একাই আসলে সেদিন এভাবে রাস্তায় নেমেছিল। আর কেউ গায়ে শ্লোগান লিখে রাস্তায় নামেনি সেইদিন।”

নূর হোসেনের ভাই আলী হোসেনের মনে আছে দুঃসংবাদটি এসেছিল দুপুরের দিকে। সবাই কানাঘুষো করছিল। খবরটিকে বিশ্বাস হয়নি তার।

“দুদিন আগে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আমাদের বলে যায়, একটা জায়গায় যাচ্ছি, চিন্তা কইরেন না‍।”

নূর হোসেনের অটোচালক বাবা মুজিবুর রহমান ততদিনে বুঝে ফেলেছেন, তার ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে, ছেলে মিছিলে যায়।

“পরপর দুই রাত যখন ও ঘরে ফিরলো না, তখন আব্বা ৯ই নভেম্বর ওর খোঁজে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে গেলেন। নূর হোসেন কখনো কখনো সেখানে থাকতো। কিন্তু সেখানে পাওয়া গেল না। নূর হোসেন নাকি রাতে একটা মসজিদে ঘুমাতো। ক্লাবের লোকজন বললো আপনি সকালে ঐ মসজিদে গেলে পাবেন,” বলছিলেন আলী হোসেন।

দশ তারিখ সকালে নূর হোসেনকে ধরার জন্য তার বাবা-মা ভোরবেলা নামাজের পরেই বেরিয়ে গেলেন।

“রাজউকের কাছে একটা মসজিদে গিয়ে আব্বা ওকে পায়। আব্বা আমাকে পরে জানিয়েছিল, সেখানে গিয়ে উনি দেখেন, নূর হোসেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ও আব্বা আম্মাকে দেখে চমকে গেল। উঠে তাড়াতাড়ি গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিল। আব্বা জিজ্ঞেস করছে, তোর গায়ে কী লেখা আছে? ও বললো কিছু না।”

“আব্বা জিজ্ঞেস করলো, তুই কি আজকে মিছিলে যাবি? ও বললো, না না, মিছিলে টিছিলে যাব না। আপনারা যান, ঘরে যান।”

“বাবা বললো, তোর এখানে থাকার দরকার কী? এখানে এই মসজিদে থাকার দরকার কী?”

নূর হোসেন এ কথার উত্তর দেয় না। বলে আমাার কাজ আছে। কাজ শেষে ফিরবো। এই বলে বাবা-মাকে রিকশায় তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

“দুপুরের দিকে আমার বাবা-মার কাছে খবর আসলো যে ছেলে গুলি খেয়েছে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়লো। আমি, আমার আব্বা, আমার নানী, আমরা তিনজন বেরুলাম। গুলিস্তানে পার্টি অফিসে (আওয়ামী লীগ) গেলাম। জিজ্ঞেস করতে। কেউ কিছু বলতে পারে না।”‍

“একটা লোক, নূর হোসেনের বন্ধু, তসলিম ওর নাম। উনি বললো, নূর হোসেন গুলি খেয়েছে, আমি জানি। সবাই বলাবলি করছে। গুলি খাওয়ার পর একটা রিকশায় তুলেছিল। পরে ওখান থেকে পুলিশের ট্রাকে তুলেছে। পুলিশ হাসপাতালে নিয়েছে।”

“আমরা দৌড়ে গেলাম পুলিশ হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পর বলা হলো, না এখানে আনে নাই।”

“এরপর আমরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গেলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ওরা কেউ কিছু বলতে পারছে না। তখন আমরা বললাম, আমাদের ঢুকতে দেন, আমরা দেখি। কিন্তু আমাদের ঢুকতে দিল না।”

“কিন্তু ভেতর থেকে আসা পুলিশের এক সেপাই আমাদের বললো, একটা ছেলে আছে এখানে, ওর গায়ে পিঠে লেখা। ও ভেতরে আছে।”

“তখন আব্বা ঐ পুলিশের রাইফেল ধরে টান দিয়ে বললো, আমাদের ভেতরে যেতে দিতে হবে। নইলে এই রাইফেলের বাট দিয়ে আমি তোমার মাথা ফাটিয়ে দেব।”

“হট্টগোল শুনে ভেতর থেকে অফিসাররা চলে এসেছে। একজন পুলিশ অফিসার তখন আব্বাকে বললো, এখানে যদি এখন আমরা আপনার ছেলেকে দিতে যাই, আরও লাশ পড়বে। আপনি কি তা চান?”

নিরাশ হয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ফিরে এলেন তারা।

এনায়েত কবীর তখন সচিত্র সন্ধানী বলে একটি ম্যাগাজিনের সাংবাদিক। সকালেই রিকশা নিয়ে চলে এসেছিলেন নয়াপল্টন সন্ধানী অফিসে।

“পল্টন থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় তখন প্রচুর মানুষ ছিল। প্রচুর মানুষ।”

“নাসির আলি মামুন তখন আমাদের আলোকচিত্রী। উনি পল্টন এলাকা থেকে খুব হন্তদন্ত হয়ে সন্ধানী অফিসে এলেন। উনি আমাকে বললেন, প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে পল্টন এলাকায়। আমি মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।”

“সামনে গিয়ে দেখলাম সেখানে ২০/২৫ জনের একটি মিছিল। সেখানে এই ছেলেটি। মিছিলটি পল্টন থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে আবার ফিরে আসছিল।”

“সম্ভবত আমিই একমাত্র লোক, যে নূর হোসেনকে জীবিত অবস্থায় দেখি, আবার মৃত অবস্থায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দেখি।”

“তখন পল্টন মোড়ের কাছে কবির হোটেল বলে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। পুলিশের সঙ্গে মারামারি শুরু হওয়ার পর সেখানে গিয়ে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছিল। আমিও সেখানেই ঢুকলাম। তখন কয়েকজন পুলিশ সেখানে এসে ভয়ংকরভাবে আমাদের পেটানো শুরু করলো। পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি করলো। আমার আঙ্গুলে ছররা গুলি লাগলো। এরপর পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল।”

“পুলিশ কন্ট্রোলরুমের একটি সেলে আমি আবার নূর হোসেনকে দেখি। তখন তিনি গুলিবদ্ধ। সেখানে আরও কয়েকজনের গুলিবদ্ধ দেহ ছিল। আমার ধারণা নূর হোসেন তখনো জীবিত ছিল। আমরা অনেক চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। একটা পর্যায়ে চিৎকার থেমে গিয়েছিল।”

“নুর হোসেনকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে না নিয়ে যদি হাসপাতালে নেয়া হতো তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত।”

খ্যাতিমান আলোকচিত্র সাংবাদিক পাভেল রহমান তখন কাজ করেন নিউ নেশনে, ইত্তেফাক হাউজের একটি ইংরেজি দৈনিকে।

তিনি ছিলেন সেই গুটিকয় আলোকচিত্রীদের একজন, যারা মিছিলে যাওয়া নূর হোসেনের ছবি তুলতে পেরেছিলেন।

“১০ই নভেম্বর সকালেই আমি মোটরসাইকেলে পুরো শহর চক্কর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, হটস্পট কোনগুলো হতে পারে, কোত্থেকে ভালো ছবি পাওয়া যেতে পারে। আমার মনে হলো পুরানা পল্টন মোড়টাই সবচেয়ে উত্তপ্ত। সেখানে বামপন্থী দলগুলোর কর্মীরা জড়ো হচ্ছিল। তাদের প্রত্যেকের হাতে বাঁশের কঞ্চিতে লাল পতাকা বাঁধা‍।”

শীতের সকাল। রোদ বাড়ছিল। আটটা সাড়ে আটটার দিকে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের এক দফা সংঘর্ষ হয়ে গেল।

“কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখলাম সেখানে আমার ঠিক গা ঘেঁষে একটি ছেলে চলে যাচ্ছে। ছেলেটার পুরো পিঠজুড়ে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’- যেন এক চলমান পোস্টার। ওকে দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আমি ক্যামেরাটা চোখে তুললাম। দুটি শট নিলাম। একটা হরাইজন্টাল। একটা ভার্টিক্যাল।’

“এটা তোলার পরপরই আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, ছবিটা যেন কেবল আমার এক্সক্লুসিভ থাকে। অন্য কেউ যেন না পায়।”

এরপর ছেলেটা মিছিলে হারিয়ে গেল। তাকে আর খুঁজে পেলেন না পাভেল রহমান।

“সন্ধ্যায় ইত্তেফাকের ডার্করুমে আমি কাজ করছিলাম। ঐ ছবিটা যাতে আমার কাছ থেকে আর কেউ নিতে না পারে, সেজন্যে আমি সতর্ক ছিলাম। নিউ নেশনে তারেক বলে এক রিপোর্টার ছিলেন। উনি আমার ডার্করুমের দরোজায় নক করলেন। উনি বেশ উত্তেজিত। বললেন, পাভেল আপনি একটা ছবির কথা বলেছিলেন, ঐ ছেলেটি সম্ভবত গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ঐ ছবিটা কিন্তু প্রিন্ট করতে ভুলবেন না।”

“তখন আমানউল্লাহ কবির ছিলেন নিউজ এডিটর। উনিও বেশ উত্তেজিত। ততক্ষণে নূর হোসেনের মৃত্যুর খবর চলে এসেছে। কিন্তু ছবিটা প্রকাশ করা যাবে কীনা, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিল।”

“আমরা তখন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের (নিউ নেশনের প্রকাশক) কাছে যাই, আমি এবং আমানউল্লাহ কবির। কিন্তু উনি কিছুতেই ছবিটি প্রকাশের অনুমতি দিচ্ছিলেন না। উনি বলছিলেন, এরশাদ ক্ষমতায়, আমি এই ছবি ছাপলে কিছুতেই উনাকে সামাল দিতে পারবো না। উনি ক্ষিপ্ত হবেন।”

“শেষ পর্যন্ত উনি রাজী হলেন। বললেন, ছাপা যাবে, তবে ছোট করে পত্রিকার ফোল্ড বা ভাঁজের নীচে ছাপতে হবে। ডাবল কলামে। এর চেয়ে বেশি নয়। আমরা তাতেই খুশি। যাক ছবিটা অন্তত প্রকাশ হবে।”

“ছবিটা প্রকাশ হওয়ার পর বেশ সাড়া পড়ে গেল। আমি কিছু ফোন পেলাম নানা জনের কাছ থেকে। প্রেসিডেন্ট নাকি খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছেন এই ছবি দেখে। সরকার বলছিল, এরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি। ফটোগ্রাফার এই ছবিটি বানিয়ে তুলেছে।”

“একথা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। কয়েকদিনের জন্য আমাকে গা ঢাকা দিতে হয়।”

দেশের কিছু প্রথম সারির নামকরা আইনজীবী তখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারে। ঢাকায় তারা এক গোপন বৈঠক করবেন। সেই বৈঠকে ডাক পড়লো পাভেল রহমানের। তারা জানতে চাইলেন, তিনি কিভাবে, কোথায় ছবিটি তুলেছেন।

আইনজীবীরা জানালেন, তারা ছবিটি চান। এটি দিয়ে তারা পোস্টার করবেন। সেই পোস্টার তারা ছড়িয়ে দেবেন সারা দেশে।

“আমি প্রায় ৪৫ বছর ধরে ফটোসাংবাদিকতায় জড়িত। কিন্তু এই একটি ছবি আমাকে যত খ্যাতি, যত পরিচিতি দিয়েছে, তা বোধহয় আর কোন ছবির বেলায় হয়নি।”

“একটি ছবি লক্ষ শব্দের চেয়ে শক্তিশালী। এই ছবিটি যেন সেটাই প্রমাণ করলো। নূর হোসেনকে দেখেই আমি চমকে গিয়েছিলাম। নিজের গায়ে শ্লোগান লেখার ঘটনা এর আগে আমি কখনো দেখিনি। সেদিন আমি কি করে ক্যামেরা তুলেছি, কি করে শাটার চেপেছি, একবার ভার্টিক্যাল, একবার হরাইজন্টাল করে ছবি তুলেছি, আমি এখনো বুঝতে পারি না, এত দ্রুত সব ঘটে গিয়েছিল।”

“এখনো যখন আমি ছবিটা দেখি, আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে জামা নেই। কোঁকড়া চুল। টগবগে এক তরুণ। এরকম দৃশ্য আর কখনো দেখিনি।”

পাভেল রহমান নূর হোসেনের মাত্র দুটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন। দুটি ছবিই ছিল পেছন থেকে।

কাজেই এই তরুণটি আসলে কে, সেটি একটি রহস্যই থেকে যেতো, যদি না আরেক সাংবাদিক দিনু আলম সামনে থেকে নূর হোসেনের অনেক ছবি তুলতে পারতেন।

বিশেষ করে যেভাবে পরিবারকে না জানিয়ে নূর হোসেনকে কবর দিয়েছিল সরকার, তাতে স্পষ্ট ছিল, তারা এই মৃত্যুর ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছিল।

সাংবাদিক দিনু আলম এখন থাকেন কানাডায়। ১৯৮৭ সালে তিনি কাজ করতেন নতুন বার্তা নামের এক পত্রিকায়।

‘সেদিন একটি ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন ঘুরছিলাম পল্টন-সচিবালয়-জিপিও এলাকায়। বহু ছবি আমি সেদিন তুলেছি। এর মধ্যে অনেকগুলো ছবি ছিল নূর হোসেনের।”

“নূর হোসেনের যত ছবি আমি তুলেছিলাম, তার সবগুলোই সামনে থেকে। তার শরীরের পেছনেও যে গণতন্ত্র মুক্তি পাক বলে শ্লোগান লেখা ছিল সেটা আমার জানা ছিল না। নূর হোসেন যেরকম দৃপ্ত ভঙ্গীতে মিছিল করছিল, সেটা আমাকে আকর্ষন করছিল।”

পুলিশ যখন গুলি চালাতে শুরু করলো, তখন দিনু আলম আশ্রয় নেন পল্টন এলাকায় তখনকার যায় যায় দিন অফিসের ওপরে। সেখানে অনেকটা শুয়ে শুয়ে তিনি কিছু ছবি তোলেন। গুলি এসে লাগছিল দেয়ালে।

“একটা গুলি এসে দেয়ালে লাগে। দেয়াল থেক সুরকি পড়লো আমার শরীরে। তখন আর সেখানে থাকলাম না। আমার মনে হলো খুব বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাচ্ছে।”

এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে আমি জিপিওর দিকে গেলাম।

সেখানে সচিবালয়ের কাছে রাস্তায় তখন চলে এসেছে শেখ হাসিনার গাড়ি বহর। দিনু আলমের তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার গাড়ির খুব কাছেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন নূর হোসেন। এই ছবিটি তিনি তোলেন একটি মোটর সাইকেলের ওপর দাঁড়িয়ে।

“আমি শুনেছি শেখ হাসিনা নূর হোসেনকে জামা পরতে বলেছিলেন এই আশংকায় যে গায়ে লেখা শ্লোগানের জন্য তাকে হত্যা করা হতে পারে।”

শেখ হাসিনার গাড়ি বহর চলে যাওয়ার পর ভিড়টা সেখানে ছিল আরও কিছুক্ষণ। সেখানে নূর হোসেনের আরও ছবি তোলেন দিনু আলম।

১৯৮৮ সালে দিনু আলম কানাডায় চলে যান। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর তোলা সবগুলো ছবি তিনি এখনো সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো তিনি সবাইকে বিনামূল্যে ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছেন।

“আমার মনে হয়েছে এগুলো আমাদের ইতিহাসের অনন্য দলিল। এই ছবি তাই আমি সবার সঙ্গে শেয়ার করেছি।”

নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লিখে দেয়ার গল্পটা ইকরাম হোসেন শুধু করেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুর কাছে।

“আমি বলেছিলাম, আমি একটা অদ্ভূত কাজ করেছি, একজনের গায়ে শ্লোগান লিখেছি। জীবনেও এরকম কাজ করিনি।”

১১ই নভেম্বর এক বন্ধু ছুটে এলেন ইকরাম হোসেনের কাছে।

“আমার বন্ধু এসে বললো, ইকরাম, তুই যে ছেলেটার বুকে পিঠে লিখেছিস, সেই ছেলেটা তো মারা গেছে।”

“আমার মাথায় তো তখন আসমান ভেঙ্গে পড়েছে। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইত্তেফাক অফিসে ছুটে গেলাম। আমাদের বঙ্গভবনের পাশেই তো ইত্তেফাক, তারপর ইনকিলাবের অফিস। পত্রিকায় ছাপা হওয়া পেছন থেকে তোলা ছবিটা আমি দেখলাম। শ্লোগানের শেষের দুইটা দাড়ি এবং হাতের লেখা দেখে আমি বুঝতে পারলাম, এটা আমার লেখা, এটাই নূর হোসেন। ইনকিলাবে ছাপা হয়েছিল নূর হোসেনকে রিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার ছবি। সেটা দেখে আরো নিশ্চিত হলাম, এটা নূর হোসেন।”

“যখন আমি বুঝতে পারলাম, নুর হোসেন মারা গেছে। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম সেখানে। আমার মনে হলো, নূর হোসেন নিহত হওয়ার জন্য আমিই দায়ী। আমার জন্যই ছেলেটা মারা গেছে।”

ইকরাম হোসেন তার বন্ধুদের অনুরোধ করলেন কাউকে ঘটনাটা না বলতে। সবাই তখন হন্যে হয়ে খুঁজছে নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লিখে দেয়া লোকটিকে। পুলিশ, গোয়েন্দা, সাংবাদিক-সবাই তাকে খুঁজছে।

“যদি তখন আমার নাম কেউ প্রকাশ করতো, আমার পুরো পরিবারকে জেনারেল এরশাদ বন্দী করতেন। আমার ভাই তখনো প্রেসিডেন্টের চাপরাশি।”

“আমি তিন বছর প্রায় পালিয়ে ছিলাম। বাড়িতে ফিরতাম না। সাংবাদিক দেখলেই ভয় পেতাম। সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী নূর হোসেনের বাসায় গিয়ে খুঁজতো।”

“আমি বহুদিন নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। নিজেকে আমার অপরাধী মনে হতো।”

“এরশাদের পতনের পর ৯১ সালে দুজন সাংবাদিক আমার কাছে আসলো। আমি তখন হাটখোলায় আমার নিজস্ব দোকান দিয়েছি, আর্ট হ্যাভেন নামে। এবার আমার মনে হলো, এখন তো আর ভয় নেই। সেই প্রথম সবাই জানলো, আমিই লিখেছিলাম নূর হোসেনের বুকে পিঠে শ্লোগান।”

“একবার আমি নূর হোসেনের বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমি বললাম, আমার দোষে আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে। আমি অপরাধী। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার এক ছেলে মারা গেছে। কিন্তু তুমিও তো আামার এক ছেলে। তুমি কোন অন্যায় কর নাই। তখন আমার মাথা থেকে যেন একটি বোঝা নেমে গেল। আমার বুকটা যেন হালকা হলো।”

বনগ্রাম রোডের বাড়িতে এক সপ্তাহ পর একটি খবর এসে পৌঁছালো। ততদিনে তারা জেনে গেছেন নূর হোসেন মারা গেছেন। কিন্তু তার লাশটি কোথায়, কেউ বলছিল না, কোথাও সেটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

আলী হোসেন জানান, “আমাদের কাছে খবর এলো যে তাকে জুরাইন কবরস্থানে মাটি দিয়েছে। তাকে সহ মোট তিনজন। বাবুল, ফাত্তাহ এবং নুর হোসেন। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি, পুলিশ কবরস্থান পাহারা দিচ্ছে।”

নূর হোসেনের পরিবার কবর খুড়ে লাশ দেখতে চাইলেন। কিন্তু পুলিশ উঠাতে দিল না।

কিন্তু কীভাবে তারা নিশ্চিত হলেন, এই তিনটি কবরের একটিতে নূর হোসেন সমাহিত?

আলী হোসেন বললেন, “যারা মাটি দিয়েছে, যারা গোসল করিয়েছে, তারা বলেছে। ওরা বলেছিল, নূর হোসেনের শরীর থেকে আমরা রঙ উঠাতে পারি নাই। পরনের প্যান্ট কেটে খুলতে হয়েছিল। পরে কাফনের কাপড় পরিয়ে কবর দিয়েছে।”

একই কথা জানালেন শ্লোগান লেখক ইকরাম হোসেন।

“আমি নূর হোসেনের গায়ে শ্লোগান লিখেছিলাম এনামেল পেইন্ট দিয়ে, তেল রঙ। যে লোকটি নূর হোসেনের লাশ দাফন করেছে, তার সঙ্গে আমার পরে কথা হয়েছিল। আমাকে বলেছিল, ইকরাম ভাই, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, লেখাটা তুলতে পারিনি। আমি বলেছিলাম, এটা যেহেতু এনামেল পেইন্ট, এটা পানি দিয়ে ধুয়ে উঠানো যাবে না। কেরোসিন তেল দিয়ে ঘষে তুলতে হয়।”

১৯৮৭ সালের এই আন্দোলন জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছিল। অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে তিনি ২৭শে নভেম্বর দেশে আবার জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন।

কিন্তু তিন বছর পর আবারও এরকম এক গণবিক্ষোভের মুখেই তার পতন ঘটে।

তাকে কারাবন্দী করা হয়। দুর্নীতির মামলায় সাজাভোগ করতে হয়।

১৯৯৭ সালে তিনি মুক্তি পেলেন জেল থেকে। মুক্তির পরই তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন বনগ্রাম রোডে নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে।

আলী হোসেন জানান, “জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটি পাজেরোতে চড়ে উনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার বাবা মার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমার বাবাকে বললেন, আপনার ছেলে থাকলে আপনার জন্য যা করতো, আমি তাই করবো। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এটা ভুল হয়েছে।”

এরপর বহু বছর জেনারেল এরশাদ যোগাযোগ রক্ষা করে গেছেন নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে।

কিন্তু তারপর আবার সেই সম্পর্কে ছেদ ঘটলো।

“একবার আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের এক সভায় বলেছিলেন, এদেশে যেন আর স্বৈরাচারের জন্ম না হয়। এটা শুনে এরশাদ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি আব্বাকে বলেছিলেন, আপনি আবার আমাকে স্বৈরাচার বললেন? তখন থেকে এরশাদ আর আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি।”

৩৩ বছর আগে ১০ই নভেম্বর, ১৯৮৭ সালে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে যা ঘটেছিল, তা ছিল অভূতপূর্ব।

ঢাকার কারাগারগুলো সেদিন উপচে পড়েছিল রাজনৈতিক বন্দীর ভিড়ে। হাজার হাজার মানুষকে সেদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল।

নাসির-উদ্-দুজা তখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা। পরে তিনি ডাকসুর এজিএস নির্বাচিত হন।

আমরা দুজন গ্রেফতার হয়েছিলাম একই দিনে একই সময়ে ঢাকার পুরানা পল্টনের একই স্পট থেকে। পুলিশের একই ভ্যানে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে। সেখানে আমরা সারাদিন বন্দী ছিলাম নূর হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশের পাশে। রাতে আমাদের চালান করা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

নাসির-উদ-দুজা ছিলেন ১৯৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রথম সারির নেতাদের একজন। তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের মুখেই পতন ঘটেছিল জেনারেল এরশাদের সরকারের।

তিনি এখন থাকেন টরোন্টো, কানাডায়।

যে আন্দোলন তারা করেছিলেন সেটি নিয়ে এখনও তিনি গর্বিত।

“এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল, এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব ছিল। সামরিক শাসনের কবর রচনা করে আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথ তৈরি করেছিলাম।”

কিন্তু সেই গণতন্ত্রের এখন যে অবস্থা, সেটা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ।

” আমাদের প্রজন্মের আমরা আমাদের পুরো যৌবন বিসজর্ন দিয়েছি। তারুণ্যের প্রেম বিসর্জন দিয়েছি। ভালোভাবে পড়াশোনা করে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছি। কেন? আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল- বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।”

“নিজেদের ক্ষুদ্র দলীয় আর ব্যক্তি স্বার্থে আমাদের নেতা-নেত্রীরা আমাদের সেই স্বপ্নকে হত্যা করেছেন। আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে পারবো না।”

এসএইচ-০১/১০/২২ (মোয়াজ্জেম হোসেন, বিবিসি)