মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিনিয়োগের জায়গা সংকুচিত!

চলমান অস্থির অর্থনীতি আর বাজার দরের ঊর্ধ্বগতির এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট আয়ের একজন মানুষের জন্য বিনিয়োগের জায়গা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে।

সঞ্চয়পত্র অথবা ব্যাঙ্কে যে ধরনের বিনিয়োগ জনপ্রিয় ছিল তাতে সুদের হার কমিয়ে দেয়ার কারণে সেগুলো আর ততটা লাভজনক নেই তাই অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

আর্থিক খাতের দুর্বলতা, সুশাসন আর নজরদারির অভাবেও মধ্যবিত্তের জন্য অনেক বিনিয়োগ নিরাপদ নয়।

তাহলে সংসারে খরচের পর সঞ্চিত টাকা – পরিমাণে সামান্য হলেও – কোথায় বিনিয়োগ করবে মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ?

ব্যক্তিগত ও কোম্পানি বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ মোঃ সোহাগ বলছেন, সরকার সম্প্রতি সুদের হার কমিয়ে দেবার পরও সাধারণ মানুষের জন্য এখনো পর্যন্ত সবচাইতে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র।

বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়।

যাদের সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।

আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন বছরের জন্য তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র।

এটা কেনা যাবে সকল সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয়, ডাকঘর এবং সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়ে।

অনেক ব্যাংক রয়েছে যারা সঞ্চয়পত্র করার সকল ঝামেলার কাজ, সুদের টাকা সরাসরি ব্যাংকে অ্যাকাউন্টে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।

সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র করা যায়। পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রতি মাসে পাওয়া যায়।

পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখের নিচে বিনিয়োগে মুনাফায় কর ৫ শতাংশ এর উপরে গেলে ১০ শতাংশ উৎসে কেটে রাখা হয়।

মোঃ সোহাগ বলছেন সঞ্চয়পত্রের আর একটি বড় সুবিধা হচ্ছে আয়কর রিটার্ন দেবার সময়ে এর মাধ্যমে কর রেয়াদ সুবিধা পাওয়া যায়।

মোঃ সোহাগ বলছেন, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে আপনি নিজের টাকা সঞ্চয় করছেন যার বিনিময়ে সুদ পাচ্ছেন। কিছু ব্যাংক সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দিয়ে থাকে।

ব্যাংক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর থেকে বেশিও দিয়ে থাকে। তবে কয়েক বছর আগের চেয়ে তা সবার ক্ষেত্রে কম।

এতে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য, যেমন তিন, পাঁচ বা দশ বছরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ জমা রাখবেন। নানা ব্যাংকে মাসে একশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দেয়া যায়।

কোন কোন ব্যাংক প্রতি মাসে সুদ দিয়ে থাকে, আবার কোনো ব্যাংক তিন মাস বা ছয়মাস অন্তর সুদ দেয়। এছাড়া এককালীন ডিপিএস রয়েছে যার সুদ মেয়াদ শেষে পাবেন।

ডিপিএসে সেভিংস অ্যাকাউন্টের মতো যখন তখন টাকা তোলা যাবে না।

সাধারণত বিভিন্ন মেয়াদে ও সুদে সরকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এসব বন্ড নিলামে কেনা-বেচা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী।

দুই বছর থেকে শুরু করে ২০ বছর পর্যন্ত মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। এসব বন্ডে সুদের হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে শুরু করে ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে।

প্রতি ছয় মাস অন্তর মুনাফা তুলে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের কোন সীমা নেই যেমনটা রয়েছে সঞ্চয়পত্রে।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎস কর দিতে হয়। ট্রেজারি বন্ডে মুনাফা গ্রহণের সময় পাঁচ শতাংশ কর দিতে হয়। ট্রেজারি বন্ড কেনা বেচারও সুযোগ রয়েছে। বেচার সময় লাভে বিক্রি করা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স বিভাগের অধ্যাপক নওশীন রহমান বলছেন, “জমির দাম সাধারণত কমে না বরং বাড়তেই থাকে সেটাই আমরা দেখি। সারা বিশ্বের জন্য সেটি প্রযোজ্য। তাই এটিকে ভাল বিনিয়োগ বলা যেতে পারে।”

“ইদানীং মানুষজনের মধ্যে জমি কেনার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এমনটা দেখছি, বিশেষ করে যাদের একটু লিকুইড ক্যাশ রয়েছে।”

জমি কেনার আগে ভবিষ্যতে দাম বাড়বে এরকম জায়গা যদি নির্বাচন করতে পারেন তাহলে আরও লাভ। আর জমিতে কোন ঝামেলা আছে কিনা সেটি ভালো করে খবর নিয়ে দেখতে হবে। কোন ভুয়া লোকের খপ্পরে পড়লেই বিপদ।

জমির মাটি উঁচু ভবন তৈরি করার মতো কি না, আশপাশে কোন স্থাপনার জন্য জমির দাম বাড়তে পারে কি না, জমির কাছে রাস্তা আছে কি না, ড্রেইনেজ সিস্টেম তৈরি হয়েছে কি না, এলাকাটি ভবিষ্যতে উন্নত হবে কি না – এসব যাচাই করে কেনা উচিৎ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরী বলছেন, কোন বিষয় না বুঝলে তাতে বিনিয়োগ না করাই ভালো।

“যেমন ট্রেজারি বন্ড হয়ত সবার জন্য নয় কারণ এটি নিলামের মাধ্যমে নিতে হয়, কেনার ঝামেলা আছে, এটি সবাই বুঝতে পারে না।”

তিনি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধান হতেও পরামর্শ দিচ্ছেন।

তার ভাষায়, “সঞ্চয়পত্রের মতো স্থিতিশীল বিনিয়োগে সুদের হার কমে গেলে মানুষজন মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেমন শেয়ারবাজার বাংলাদেশে খুবই অস্বচ্ছ একটা জায়গা, বিভিন্ন গ্রুপ ইন্টারনাল ট্রেডিং-এর মাধ্যমে দাম ওঠা নামায় কারসাজি করে।”

“শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে গেলে এটা ভালো করে বুঝতে হয়। সঞ্চয়পত্রের মতো কিনে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। অতএব এখানে বিনিয়োগে সাবধান হতে হবে। আমরা নানা সময়ে দেখেছি যারা শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা স্বল্প পুঁজির মানুষ।”

এছাড়া অনেক সুদের লোভ দেখায় এমন অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন।

এসএইচ-১১/১০/২২ (অনলাইন ডেস্ক. সূত্র : বিবিসি)