অনাকাক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ৪৩ হাজার কোটি টাকা চায় বিদ্যুৎ বিভাগ

দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের; বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও রয়েছে। এর পরও বর্তমানে বিদ্যুতের যে সংকট চলছে, এর মূল কারণ জ্বালানির সংকট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানি প্রয়োজন, তা আমদানিনির্ভর। জ্বালানির অভাবেই মূলত প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎ সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। সঙ্গত কারণেই এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের শিল্পকারখানা তথা উৎপাদনমুখী খাতে। এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসকে ভিত্তিকাল ধরে সরকারের কাছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকার (চার বিলিয়ন ডলার) চাহিদাপত্র দিতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অর্থ মন্ত্রণালয় যেন এ অর্থ দ্রুততার সঙ্গে ছাড় করে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন মাসে কি পরিমাণ অর্থ লাগবে, তাও সবিস্তারে প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ; পারছে না বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানির দাম যথাসময়ে পরিশোধ করতে। একদিকে পাওনাদারদের অর্থ সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না, বকেয়া পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ; অন্যদিকে অর্থ বিভাগ থেকে সময়মতো টাকা ছাড় করা যাচ্ছে না। এ কারণেই সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিদ্যুৎ বিভাগ যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে, এর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অর্থের জোগানকেই দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানই বিদ্যুৎ বিভাগের মূল লক্ষ্য।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রয়োজনীয় জ্বালানি অর্থাৎ ফার্নেস অয়েল, ডিজেল, কয়লা, গ্যাস প্রভৃতির বিপরীতে কি পরিমাণ টাকা লাগবে, তার একটি হিসাব প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। পাশাপাশি এই কর্মপরিকল্পনার একটি করে কপি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আগামী জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে অর্থের সংস্থানে একটি হিসাব তৈরি করা হয়েছে। সেটা প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের মতো। এই পরিমাণ টাকা পেলে কিছু বকেয়া পরিশোধ করাসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, তেল ও গ্যাস আমদানি করা যাবে। এতে করে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা যাবে।

তিনি আরও বলেন, শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ এখন শিল্পকারখানায় বিদেশি অর্ডার আসবে। এসব অর্ডার নিয়ে শিল্পমালিকরা কাজ করতে পারলে ডলারের সংকটও দূর হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভাগের ভর্তুকি বকেয়া পড়ে আছে ২৯ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে এ সময়ে মাত্র ২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আইপিপি, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ আরও বকেয়া রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভারত হতে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিল, ইসিএ অর্থায়নে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পগুলোর রিপেমেন্ট, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার দাম হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রায় ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য আরও প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের হিসাব নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বকেয়া বিল বাবদ যে অর্থের প্রয়োজন, সেখানে রয়েছে ভারত হতে আমদানিকৃত বিদ্যুতের বিল পরিশোধের জন্য ৪৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রয়োজন হবে ১ হাজার ৭৫৫ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইপিপি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ইতোমধ্যে ৫৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। গত অর্থবছরের জন্য আরও ৮৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাকি সময়ের জন্য আরও দরকার ২৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যৌথ উদ্যোগে ও আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য কয়লা আমদানি বাবদ ৫৭৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য লাগবে ১ হাজার ৫১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) জন্য ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বিআইএফপিসিএলের ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি ব্যয়ও রয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ডিজেলভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধের জন্য বকেয়া ১৬১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। ইসিএ অর্থায়নে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসমূহের রিপেমেন্ট করার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৭৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দরকার। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সামগ্রিক হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বকেয়া পরিশোধে ২ হাজার ১৮৭ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অথবছরের জন্য ৩ হাজার ৭৩৩ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দরকার হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিশাল কর্মযজ্ঞ করেছে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা বাড়িয়েছে কল্পনাতীত। এতকিছুর পরও যদি জ্বালানির কারণে বিদ্যুৎ সংকট দেখা যায়; সেটা মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। ফলে সরকার চায় না, এ সময়ে বিদ্যুৎ সংকট বা লোডশেডিং হোক।

তিনি আরও বলেন, সারাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিতরণে লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বৈশি^ক পরিপ্রেক্ষিতে এখন ডলার সংকটে পড়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বারবার যোগাযোগ করার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সময়মতো অর্থ ছাড় করতে না পারার কারণে বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে আগামী ছয় মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে মূলত অর্থের সংস্থানই মুখ্য। এর ওপর ভিত্তি করেই কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর কাছ উপস্থাপন করা হবে।

এসএইচ-০৬/২১/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, আমাদের সময়)