বাইডেন-মোদীর বৈঠকে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশ!

নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন বুধবার। বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তার বৈঠক। এ বৈঠকে বাংলাদেশও গুরুত্ব পেতে পারে- এমন পূর্বানুমান কোনো কোনো ভারতীয় গণমাধ্যমের৷

এ সফর নিয়ে ভারতের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশকে নিয়েও ‘ধারণামূলক’ প্রতিবেদন করেছে। কোথাও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। নিশ্চিত তথ্যের মধ্যে একাটিই আর তা হলো, মোদীর সম্মানে দেয়া জো বাইডেনের নৈশভোজ এবং সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানের আমন্ত্রণ পাওয়া।

ভারত থেকে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দিল্লিতে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থে’ অ্যামেরিকা সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে দিল্লি তাদের মনোভাব অবশ্যই ওয়াশিংটনের কাছে তুলে ধরবে।”

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন মোদী-বাইডেন বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন,” ভারত অত্যন্ত পরিপক্ক গণতান্ত্রিক একটি দেশ। ভারতের নেতৃত্বও অত্যন্ত পরিপক্ক ও সমৃদ্ধ। বৈঠকে যা ভালো মনে করবেন, তা নিয়েই তারা (মোদী-বাইডেন) আলাপ করবেন। ওখানে আমার (বাংলাদেশের) ওকালতি করার প্রয়োজন নেই।” তিনি বরং জানতে চান,”ওইসব দেশের বৈঠকে কে কী নিয়ে আলাপ করবে তা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কেন?”

সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন মোদী-বাইডেনের আসন্ন এ বৈঠকে বাংলাদেশের গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়৷ তিনি বলেন, “ভারতের কাছে এখন প্রচুর অর্থ আছে। তারা উদীয়মান অর্থনীতি। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন অর্থের প্রয়োজন। তাই তারা এখন ভারতের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়। ভাররতের জন্য চীন একটা ভয়ের ইস্যু। এটাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসাটা করতে চায়। রাশিয়া থেকে যেসব সামরিক সরঞ্জাম ভারত কিনতো আমেরিকা চায় এখন ভারত সেটা তাদের কাছ থেকে কিনুক। এর মধ্যে এয়ারক্রাফট আছে, অস্ত্র আছে, ড্রোন আছে। এখানে ভারত টেকনোলজি ট্রান্সফার চায়। কিন্তু অ্যামেরিকা সেটা পুরোপুরি করবে না।”

তার মতে,”মনে রাখতে হবে ভারত কিন্তু অ্যামেরিকার ইকুয়াল পার্টনার না। ভারতের মানবাধিকার, গণতন্ত্র নিয়েও বাইডেন প্রশাসনের প্রশ্ন আছে। এবারের সফরে হয়ত সেটা উঠবে না। কিন্তু এটাকে তারা বাদও দেবে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোদী- বাইডেন আলোচনায় কেনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হওয়ার কথা নয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লিখলেই তো হবে না। তাদের কিন্তু কোনো অথেনটিক সোর্স নেই। তবে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতে পারে। সেটা মোদী কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তা কিন্তু স্পষ্ট নয়,” মন্তব্য করেন এই কূটনীতিক।

তবে তিনি মনে করেন, “মোদীর সম্মানে দেয়া নৈশভোজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিতরে হয়তো কিছু থাকতে পারে। তবে যাই থাকুক তা সাইডলাইনে বলেই আমার মনে হয়।”

যুক্তরাষ্ট্রে বাংদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির বলেন,” অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতেরই সম্পর্কে অনেক সমস্য আছে, ইস্যু আছে । সেগুলোই গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তাদের বৈঠক হবে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে। সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে মোদী কী বলবেন? যা চলছে, তা চলতে দিতে বলবেন? এটা কি সম্ভব? হয়তো ভারত চায়, কিন্তু বলা সম্ভব নয়। হয়ত বাংলাদেশ চায় মোদী কিছু বলুক, কিন্তু সেটা কি সম্মানজনক?”

তার কথা,” বাংলাদেশ যাতে চীন রাশিয়ার দিকে না ঝুঁকে পড়ে- এই যে একটি কথা তৈরি করা হয়েছে, এটার জন্য ভারতের দরকার নেই। এই কূটনীতি অ্যামেরিকা নিজেই করতে পারে। বাংলাদেশও তার অবস্থান নিয়ে কথা বলতে পারে। এজন্য তৃতীয় দেশের ভূমিকা রাখার কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি।”

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,” অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতের এমনিতেই সম্পর্কের একটি টানাপোড়েন আছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের কারণে। তারপর ব্রিকস সম্মেলন নিয়ে অ্যামেরিকা অস্বস্তির মধ্যে আছে। কারণ, ওটা আরো শক্তিশালী হয়ে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটে হয়তো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথার মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতে পারে। তবে আলাদা করে আসার মতো কিছু দেখছি না।”

তার কথা,” ভারতের সংবাদমাধ্যম, কূটনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা তাদের সবার মধ্যে একটা বিষয় আছে যে তারা বিগ পাওয়ার। তারা বাংলাদেশকে অনেক কিছু পাইয়ে দিচ্ছে বা দিতে পারে। তাই তারা নানা কথা বলে। একজন বলে হাসিনার পাশে এবার থাকবে না ভারত, আবার আরেকজন বলে বাংলাদেশের জন্য কাজ করবে ভারত। ভারতের এমন কোন সক্ষমতা আছে যে তারা চাইলে অ্যামেরিকাকে বলে বাংলাদেশের বা বর্তমান সরকারের ব্যাপারে তাদের পলিসির পরিবর্তন ঘটাতে পারে?”

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে যে বাংলাদেশে ঠিকমতো ভোট হোক। ভোটে যাতে কোনো কারচুপি না হয়। ভারত কী চাচ্ছে? ভারত চাচ্ছে এখানে আওয়ামী লীগ সরকার কন্টিনিউ করুক। কারণ, ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক। চীনের ব্যাপারে দুই দেশের স্বার্থের সমতা আছে। চীন এই অঞ্চলে যাতে আধিপত্য বিস্তার না করতে পারে এটা দুই পক্ষই চায়। চীনের ব্যাপারে তাদের স্বার্থের ঐক্যমত আছে , বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপারে নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তো সরকার পরিবর্তন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে সিরিয়াস। কারণ, এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন যখন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে, তখন মতপার্থক্যের বিষয় নিয়েও কথা হবে। তাই বাংলাদেশ প্রসঙ্গও আসতে পারে। ”

তার বিবেচনায় এর কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, “ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার দোভাল ( অজিত দোভাল) বলেছেন, তারা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যাতে তাদের (ভারতের) নিরাপত্তার সংকট হয়। বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ প্রসঙ্গে এটা তিনি বলেছেন। এখন নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে তো কথা হবে। ফলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা হবে।”

তার কথা, “বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে মোদীর সম্মানে দেয়া নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার কারণে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়তো সেখানকার পরিস্থিতির কারণে পাননি। এটা দিয়ে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ কিনা তা বোঝা যায় না।”

তিনি বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী বললেন তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি বলতেই পারেন, আমাদের ওকালতি করতে হবে না, কিন্তু ভারতের মাধ্যমে এক ধরনের পারস্যুয়েশন তো আমরা দেখতে পাই।”

এসএইচ-০৭/২১/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন. ডয়চে ভেলে)