বিদেশিদের কাছে তালিকা পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির পর বিদেশিদের কাছে তালিকা পাঠানোর রাজনীতিতে নেমেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি৷

গত মাসে বিএনপির কয়েকজন নেতার নির্বাচনবিরোধী বক্তব্য সংযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ. আরাফাত৷ সেখানে তিনি বলেছেন, মার্কিন ভিসা নীতি বিএনপির নেতাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে৷

অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, হামলা ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে সম্প্রতি ৩৩ জন পুলিশ সদস্য এবং ১০ জন আওয়ামী লীগ নেতার তালিকা বিদেশি দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনে পাঠিয়েছে বিএনপি৷ বিএনপি বলছে, এরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে বাঁধা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত৷

অবশ্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এই রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি তাদের এই তৎপরতার নিন্দা জানাই৷ আমাদের দেশটাতো স্বাধীন রাষ্ট্র৷ এখানে অনেক সমস্যা আছে এটা সত্যি৷ অনেক সম্ভাবনাও আছে৷ তালিকা তৈরি করে কোন দেশের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে এটা আমি মনে করি তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ৷ নিখুঁত প্রমাণ৷ কোন দেশে বিশৃঙ্খলা হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা বলার রেওয়াজ আছে৷ কিন্তু এইভাবে যদি আমরা তালিকা সরবরাহ করতে থাকি আর সালিশ মানতে থাকি তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের মানটা কোথায় থাকে? এই কথাটা বলার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ এটা সাধারণ একটা বিষয়৷ আমাদের যে সমস্যা সেটা নিজেদেরই সামাধান করতে হবে৷ সেটা আলাপ-আলোচনা করে হতে পারে৷ কিন্তু কাউকে কর্তা মেনে এটা করা আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না৷”

বিএনপির তালিকায় ৩৩ পুলিশ ও ১০ আওয়ামী লীগ নেতা

গত ৩ জুন বিএনপি ১৪ সদস্যের একটি তথ্য সংগ্রহ কমিটি গঠন করেছে৷ দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এর প্রধান৷ এই কমিটি ঘটনার বিবরণ, জড়িত পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে চিঠি আকারে তা দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির কাছে হস্তান্তর করে৷ সেখান থেকে বিদেশিদের কাছে পাঠানো হয়৷

গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি চালুর পর কমিটি করা হয়েছে৷ সম্প্রতি বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো ছয়টি ঘটনার জন্য ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩৩ জন পুলিশ সদস্য৷ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আছেন ১০ জন৷ এসব পুলিশ সদস্য ও সরকারি দলের নেতাদের নাম, পদবি এবং ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি তা বিদেশি মিশনে পাঠায়৷

তথ্য সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘‘বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে হামলা, মিথ্যা মামলা ও নেতাকর্মীদের নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনার নেতৃত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা, সদস্য এবং জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে৷ তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে ঘটনার বিবরণ ও জড়িতদের নামসহ আমরা দেশের মিডিয়ার কাছে পাঠাচ্ছি৷ একই সঙ্গে সেটা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বিদেশি মিশনগুলোতেও পাঠানো হচ্ছে৷ এর সঙ্গে ভিডিও, ছবি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংযুক্ত করা হয়৷ তবে পুরানো ঘটনা নয়, সম্প্রতিক সময়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোই আমরা সামনে আনছি৷”

বিএনপির তালিকায় যে ঘটনাগুলো স্থান পেয়েছে তার মধ্যে আছে গত ৮ জুন লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে পাবনায় বিদ্যুৎ অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের হামলা, পুলিশের নির্লিপ্ততা৷ এর জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর), ডিবির তিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় তিন নেতাকে অভিযুক্ত করা হয় চিঠিতে৷ এই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়৷

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) হাসিবুল বেনজির বলেন, ‘‘এই ধরনের অভিযোগ আনা হলে আমি বলব সেটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন৷ বরং পুলিশের ভূমিকার কারণেই ওই দিন সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে৷ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন৷ আমরা ভূমিকা নিয়ে তাদের নিবৃত্ত করেছি৷ কাউকে লাঠিচার্জ বা আঘাত করা হয়নি৷ ঝুঁকি নিয়ে খালি হাতে আমরা তাদের সরিয়ে দিয়েছি৷ এখন যদি এই ধরনের কথা বলা হয়, সেটা কোনভাবেই ঠিক হবে না৷”

এছাড়া ৯ জুন যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্নার মুক্তির দাবিতে কুমিল্লা জেলা যুবদলের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ হামলা করে বলে অভিযোগ আনা হয়৷ এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে ১৪ পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে৷ ১৪ জুন চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশ শেষে মিরসরাইয়ে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে ছাত্রদলকর্মী নাদিয়া নুসরাতকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং মধ্যরাতে পুরানো মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় জড়িতদের নামও পাঠানো হয়েছে দূতাবাসগুলোতে৷ এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছয়জন এবং জোরারগঞ্জ থানার ওসিসহ দুই পুলিশ সদস্যের নাম দেওয়া হয়েছে৷ ১৯ জুন বগুড়ায় তারুণ্যের সমাবেশে অংশ নিতে নওগাঁ থেকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা রওনা হলে দুপচাঁচিয়া উপজেলায় পুলিশ বাধা দেয়৷ এ ঘটনায় দুপচাঁচিয়া থানার ওসি, ওসি (তদন্ত) ও তিন উপপরিদর্শকের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়৷

বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, সমাবেশে যেতে বাধা দেওয়ার এই ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ৷ কারণ এতে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে৷ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বড় হুমকি৷

বিদেশিদের কাছে তালিকা দিয়ে বিএনপি কী অর্জন করতে চায়? জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তালিকা বিষয় না, দেশে কী হচ্ছে সেটা তো বিদেশিরা দেখছে৷ আমরা চাই দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসুক৷ নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন হোক৷ আমরা চাই দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাক৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা আর না ঘটুক৷ সাধারণ মানুষ স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাক৷”

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত গত ২৬ মে নিজের ফেসবুকে একটি চিঠি আপলোড করেছেন৷ এই চিঠিটি তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে লিখেছেন৷ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘‘আপনাদের সম্প্রতি ঘোষিত ভিসা নীতি অনুসারে যেখানে আপনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, এই নীতি বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন করে এবং যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশি নাগরিক বা যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা যখন নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে তখন তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে৷”

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘‘এখানে আমি কিছু ভিডিও ফুটেজ সংযুক্ত করেছি, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন যে, বিএনপির কিছু শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন৷ আমি আশা করি, আপনার ভিসা নীতি বিএনপির এই নেতাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে৷”

তালিকার রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  বলেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যারা জঙ্গিদের দমন করে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ভূমিকা রাখে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে বিএনপি৷ বিদেশিদের কাছে তারা নিজ দেশের সম্মানহানি করছে৷ এগুলো আমরা নির্বাচন ভন্ডুল করার অপকৌশল হিসেবে দেখছি৷ দেখেন, আমাদের স্ত্রী, সন্তানরা এখন বাসার বাইরে বের হয়ে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরে আসছে৷ রাস্তাঘাটে জঙ্গিবাদীদের বোমা হামলায় কাউকে জীবন দিতে হচ্ছে না৷ এটা সত্যি যে, কখনও কখনও কোন কোন জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে৷ জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা কিন্তু এখন বাংলাদেশকে তাদের আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে বেছে নিতে পারে না৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্যের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে বিএনপি এসব তালিকা করছে বলেই আমার মনে হয়৷”

এসএইচ-০৩/২৭/২৩ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)