নির্বাচনের আগে ফেক নিউজ নিয়ে যত উদ্বেগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রোপাগান্ডা ও কাউন্টার-প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। নির্বাচনে ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে ফেক নিউজ ছড়িয়ে আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা।

ফেক নিউজ, সিন্ডিকেটেড নিউজ, স্পন্সরড বা পেইড নিউজ হিসেবে খবর, কলাম কিংবা ছবি ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা চলছে অনেকদিন যাবত।

সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ফেক নিউজ ও ছবি ভাইরাল করার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এসবের জের ধরে কখনো কখনো সহিংসতাও হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে ভুয়া লেখকদের কলাম। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে ভুয়া বিশেষজ্ঞদের নাম ব্যবহার করে সরকারের প্রশংসামুলক শত শত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

এএফপি বলছে এসব নিবন্ধ লেখকদের বড় অংশই ভুয়া, এমনকি এসব লেখকের অনেকের কোন অস্তিত্বই নেই। যদিও তাদের লেখায় তারা বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে সরকারের প্রশংসাসূচক বিশ্লেষণ লিখেছেন।

ফেক নিউজ-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে রাজনৈতিক বিরোধ- সবক্ষেত্রেই ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি আরও মারাত্মক আকার ধারণের আশঙ্কা রয়েছে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ফেক নিউজকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ নিজেদের বিরুদ্ধে গেলে সত্যি সংবাদকেও ফেক নিউজ হিসেবে চিত্রায়িত করে কর্তৃপক্ষ কাউকে জব্দ করার সুযোগ নিতে পারে।

ফেসবুক, ইউটিউব, ভুয়া ওয়েবসাইট এবং গণমাধ্যম ব্যবহার করে ভুয়া খবরগুলো ছড়ানো হয়।

প্রকাশিত ভুয়া খবরগুলোতে ইউজারদের লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের কারণে ভাইরাল হয়ে যায়। কিছু কিছু মূলধারার সংবাদমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব তথ্য যাচাই বাছাই না করেই খবর প্রকাশ করে।

এএফপির অনুসন্ধানে যেসব ভুয়া লেখকের নিবন্ধের কথা বলা হয়েছে তার অনেকগুলো কিছু মূলধারার গণমাধ্যম যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করেছে।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেক নিউজের পাশাপাশি সিন্ডিকেটেড নিউজ, স্পন্সরড বা পেইড নিউজ হিসেবেও অনেক ভুয়া খবর, কলাম কিংবা ছবির ব্যবহার চলছে অনেক দিন ধরে।

অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমের খবর বিকৃত করেও প্রচার করা হয় সামাজিক মাধ্যমে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা দলকে নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবেও ভুয়া খবর তৈরি করে প্রচার করা হয়।

অনলাইন ব্লগ, মাইক্রো ব্লগ, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ফটো শেয়ারিং সাইট, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, পডকাস্ট থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল অনেক কিছুই সামাজিক মাধ্যমের আওতায় পড়ে, যেগুলো ব্যবহার করে এসব ফেক নিউজ বা ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে এমন একটি ভুয়া খবর ও ছবি ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে দেখানো হয়েছিল যে মি. আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা নিয়েছেন চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহের জন্য।

এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ভুয়া খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।

এমনকি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচি বা শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে ঘিরে অনেক ভুয়া খবর ও ছবি নানাভাবে আলোচনায় এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে ফেক নিউজের বিস্তার আরও ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তৌহিদুল হক বলছেন, বাংলাদেশে স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন- সব পর্যায়েই ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেয়ার ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে।

“সামনের জাতীয় নির্বাচনে এটি যে আরও অনেক বাড়বে তার ইঙ্গিত পরিষ্কার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাক্ষনবাড়িয়ার নাসিরনগরে ও ভোলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও হয়েছিলো ফেক নিউজের জের ধরে।

বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিক মাধ্যমে প্রচারকে এখন বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজ দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারিত ফেক নিউজের চ্যালেঞ্জও তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

তবে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কারা এগুলো করছে সে সম্পর্কে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না। যদিও দলগুলো এসবের জন্য পরস্পরকেই দায়ী করে থাকে।

অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা অন্য দলকে বা দলের নেতাদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য তৈরি করে ছড়িয়ে দেন।

যারা এসব দলের অনুসারী তারাও সেগুলো বেশি-বেশি করে শেয়ার করার কারণে দ্রুত এসব বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটেটিভ স্টাডিজের ফ্যাক্ট ওয়াচ প্রজেক্ট বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সুমন রহমান বলছেন, নানা ফ্যাক্টর বা- প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেই ফেক নিউজ বা সিন্ডিকেটেড কিংবা স্পন্সরড নিউজসহ নানা রকম কার্যক্রম দেখা যায় এবং বৈশ্বিকভাবেই এটা উদ্বেগজনক।

“নির্বাচন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় তাহলে এটি আরও বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ এগুলো যারা করে তাদের লক্ষ্যই থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা কিংবা খবরকে বিকৃত করে অন্যকে প্রভাবিত করা। আর নেতাদের টার্গেট করা হয় তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রহমান বলছেন, ফেক নিউজের বড় ভিকটিম হলো সাধারণ মানুষ। কারণ তারা ভুল খবর পাচ্ছে এবং অনেক সময় এই ভুল খবর দেখে তৈরি হওয়া ধারনা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

“মানুষের সত্য জানার অধিকার ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও এটি বড় বাধা তৈরি করে। শেষ বিচারে এটিও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন,” বলছিলেন তিনি।

ড. তৌহিদুল হক বলছেন, ব্যক্তিগত শত্রুকে ঘায়েল করতেও ফেক নিউজ তৈরির ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। আবার ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতেও এগুলো ব্যবহার করা হয়।

তবে তার মতে নির্বাচনের সময়ে ফেক নিউজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় দল নিরপেক্ষ ভোটারদের।

“যারা এগুলো করেন তারা জানেন এগুলোর ডিমান্ড আছে সমর্থকদের কাছে। এখন সামনে নির্বাচন। বড় দুটি দলের মধ্যে এ নিয়ে দূরত্ব আছে। এটিকে পুঁজি করে নির্বাচনকে ভোটারকে বিভ্রান্তি করতে গুঞ্জন ছড়াতে ফেক নিউজকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ভুয়া লেখক দিয়েও হতে পারে আবার ভুয়া তথ্য দিয়েও হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।

ফারুখ ফয়সল অবশ্য বলছেন যে ফেক নিউজ, মিস ইনফরমেশন বা হেট স্পিচ—সরকার, বিরোধী দল কিংবা সাধারণ মানুষ যে কেউ ছড়াতে পারে।

“এ কারণে তথ্য গ্রহীতার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। আবার কোনটি ফেক নিউজ সেটিও বিশেষজ্ঞ দ্বারা নিশ্চিত হওয়া দরকার। তা না হলে সঠিক খবরকেও ফেক নিউজ আখ্যা দিয়ে কাউকে জব্দ করার চেষ্টা হতে পারে,”  বলছিলেন তিনি।

এসএইচ-১২/০৮/২৩ (রাকিব হাসনাত,বিবিসি)