জনগণকে শায়েস্তা করার আইনের দরকারই নেই

বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন যে আইন পাশ হয়েছে, সেখানে পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ফলে নতুন এই আইনের মাধ্যমেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ রয়ে গেছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

একই সাথে এ আইনের মাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যম থেকে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে।

তবে আগের আইনে থাকা অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট নতুন আইনে রাখা হয়নি। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সাজার পরিমাণ কমানো হয়েছে। পাশাপাশি হ্যাকিং সংক্রান্ত বিষয়টি আগের আইনে ছিল না, যা এবার নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে।

এর বাইরে নতুন করে সংযোজিত গুরুত্বপূর্ণ বিধান হল – কেউ মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ দায়ের করলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

এছাড়া আগের আইনে অ-জামিনযোগ্য ধারা ছিলো চৌদ্দটি। কিন্তু নতুন আইনে সেটি কমিয়ে চারটি করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনটি সংশোধন করে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কয়েক মাস সময় ব্যয় করা হলেও খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি বরং ভীতি সৃষ্টির মতো ধারাগুলো আইনে রয়েই গেছে।

“কয়েকটি বিষয়ে সাজার ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলেও নতুন আইনেও নিবর্তনমূলক উপাদানগুলো রয়েই গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তার মতে আগের মতোই বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমতের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ‘ব্যাপকভাবে খর্ব’ করার সুযোগ নতুন আইনেও রাখা হয়েছে।

তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নতুন আইনটিকে ‘অনেক বেশি উদার ও ভবিষ্যতমুখী’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।

“আগে যেসব ধারা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে সেগুলোর সবগুলোকেই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। পাশাপাশি কেউ যাতে মিথ্যা মামলা না করতে পারে সেজন্য নতুন বিধান সংযোজন করেছি নতুন আইনে। ফলে নতুন আইন অপব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকবে না,”  বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত কয়েক বছরে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শিক্ষক ছাত্র পর্যন্ত আসামী হয়ে জেল খেটেছেন।

সে আইন নিয়ে বিতর্ক এবং উদ্বেগের মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছিল যে এতে বেশকিছু ধারার মাধ্যমে ‘যথেচ্ছ হয়রানির’ সুযোগ রয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, “শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তা আর সাইবার অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত চারটি ধারাকে অ-জামিনযোগ্য রাখা হয়েছে নতুন আইনে। আমি আশা করি আইনটি নিয়ে এখন আর কোন সমালোচনার জায়গা নেই”।

যদিও ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সাইবার সিস্টেমের নিরাপত্তার কথা বলেও ভিন্নমতকে বাধা দেয়ার সুযোগ তৈরি করা হতে পারে।

“আসলে আগের আইনে ভয়ের যে উপাদান ছিলো এখানেও সেটা রেখে দেয়া হয়েছে,” বলছিলেন তিনি।

তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে।

সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, আইনটির শুধু নাম পরিবর্তন হয়েছে, গুগত কোন পরিবর্তন এর হয়নি।

“যে নামেই হোক দরকার হলো জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার আইন। জনগণকে শায়েস্তা করার আইনের দরকারই নেই। আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ আগের মতোই আছে, যে কারণে এ আইন আমরা চাই না,”  বলছিলেন তিনি।

নতুন আইনে যে ধারার কারণে উদ্বেগ রয়ে গেছে তা হলো – কোনো ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রচার করলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।

বিলে বলা হয়েছে , “কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করেন যা বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ”।

এ ছাড়া ৩০ ধারায় আইন বহির্ভূতভাবে ‘ই-ট্রানজেকশন’ (ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে লেনদেন) সংক্রান্ত অপরাধ ও সাজার কথা বলা আছে।

তবে অধিকার কর্মীদের উদ্বেগের আরেকটি বড় জায়গা হলো-এই আইনে যে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে। পাশ হওয়া আইন অনুযায়ী এজেন্সির মহাপরিচালক ও পরিচালকগন সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন।

“আইনটিতে একদিকে ধারণা প্রসূত হয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন অবারিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তেমনি এজেন্সিও হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। অথচ এসব ক্ষেত্রে হওয়া উচিত স্বাধীন সংস্থা। এসব কারণেই সাইবার নিরাপত্তার বদলে এ আইন সাইবার নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, ইন্টারনেট বা ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ভিন্নমত প্রকাশ করা একটি অপরাধ হিসেবেই গণ্য করার সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে আইনে, যা অগ্রহণযোগ্য।

যদিও জুনাইদ আহমেদ পলক বলছেন তারা সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে পাওয়া ৯১৭টি সুপারিশ বিশ্লেষণ করে আগের আইনটিতে সে অনুযায়ী পরিবর্তন এনেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।

নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো বা তাতে মদদ দেয়া হবে অপরাধ।

এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে এজন্য দশ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল।

এছাড়া কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করলে তা যদি বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট করে বা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটনায় তাহলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইনে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আগেই বলেছিলেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘অপব্যবহার রোধ’ করার জন্য এই আইনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

অগাস্টের শুরুতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-ডিএসএ পরিবর্তন করে তার জায়গায় ভিন্ন একটি আইন আনার সিদ্ধান্তে মন্ত্রীসভা অনুমোদন দেয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে নতুন আইন হলে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ হবে।

‘’সাংবাদিকদের একটা কথা ছিল, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থাকলে একটা মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। সেটাকেও আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছি এবং সেই কারণে এই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে।”

মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ডিএসএ-এর অধীনে যেসব মামলা করা হয়েছিল সেগুলো চলবে কিন্তু সেসব মামলার কার্যক্রম সাইবার নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী হবে।

বুধবার সংসদে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো করেই সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।

তিনি বলেছেন যে জাতিসংঘ , সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের যেসব আপত্তি ও উদ্বেগের বিষয় ছিল সেগুলো নতুন আইনে রয়েই গেছে।

তিনি সংসদে জানান যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিলো সম্পাদক পরিষদ।

কিন্তু এখন নতুন আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হলেও অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি।

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আছে।

দলটির আরেকজন সদস্য হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন ৪২ ধারাসহ সব বেআইনি ধারাই বাদ দেয়া উচিত এ আইন থেকে।

তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়। যেটি আইসিটি আইন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

সেই আইনে বলা হয়, বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা দেয়া এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

২০১৬ সালে এই আইনটি সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়। এই আইনের অধীনে বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি বাড়ানো হয়।

আইসিটি অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর থেকেই এই আইনটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে বির্তক তৈরি হয়। বিশেষ করে আইনটির ৫৭ ধারা বাতিলের তুমুল দাবি ওঠে।

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছিল যে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে’।

এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল।

এই ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও সাংবাদিকদের কারাগারে নেওয়ার একাধিক ঘটনা তীব্র সমালোচনা তৈরি করেছিলো। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের তরফ থেকে এটি নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে আইসিটি আইন বাতিলের দাবি করা হয়েছিলো।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে এটি খসড়াটি সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন এই আইনে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল করে তার পরিবর্তে এসব ধারার অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হয়।

এখন আবার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পরিমার্জন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাশ করা হলো।

এসএইচ-১১/১৪/২৩ (রাকিব হাসনাত,বিবিসি)