ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ‘আপত্তি’ সত্ত্বেও আদিলুরের কারাদণ্ড

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷

এ মামলায় অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিনকেও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ রায়ের আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷ সেই বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ঢালাও কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই৷ পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো৷” কিন্তু আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, ‘‘মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই৷ গুম বন্ধ হয়নি৷ বিরুদ্ধ মতকে দমন করা হচ্ছে৷”

সরকার ‘অধিকার’-এর নিবন্ধন আগেই বাতিল করেছে৷ গত বছরের জুন মাসে অধিকার-এর এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন বাতিল করা হয়৷ আর বৃহস্পতিবার ২০১৩ সালের ৪ মে শাপলা চত্তরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে অভিযানে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ নিয়ে দায়ের করা মামলায় আদিলুর ও এলানের দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত৷

রায়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি দুইজনকেই ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়৷ রায়ের সময় দণ্ডপ্রাপ্তরা আদালতে হাজির ছিলেন৷ রায়ের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়৷

আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ডিবির তখনকার এসআই আশরাফুল ইসলাম৷ তদন্ত শেষে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়৷ অভিযোগপত্রে বলা হয়, আদিলুর ও এলান শাপলা চত্বরে ৬১ জনের মৃত্যুর বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা চালান, যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে চরমভাবে ক্ষুন্ন করে৷

বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় আদিলুর বলেন, ‘‘আমি ন্যায় বিচার পাইনি৷ এ রায়ের বিরুদ্ধে আমি উচ্চ আদালতে যাবো৷’’

তার আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘‘এই আদালত থেকে ন্যায় বিচার পাননি আদিলুর ও এলান৷ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে৷” অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আাইনজীবী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “আসামিদের সাজা বাড়ানোর জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে৷” ওই দুইজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৭ ধারায় দণ্ড দিয়েছেন আদালত৷

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এক যৌথ প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে কিনা সেটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে৷

প্রস্তাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়৷ একইসঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাজের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়৷

স্থানীয় সময় বুধবার রাতে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে প্রস্তাবটি নিয়ে পার্লামেন্ট অধিবেশনের বিতর্কে ছয় সদস্য অংশ নেন৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মধ্য ডানপন্থি, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, বামপন্থিসহ সাতটি গ্রুপ এই প্রস্তাব এনেছে৷

প্রস্তাবে বাংলাদেশে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷ ২০২৪ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়৷

প্রস্তাবে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করাসহ বাংলাদেশে নানাভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে৷

প্রস্তাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার-’এর প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার, আদিলুর রহমান খান ও এ এস এম নাসির উদ্দিনের মুক্তি এবং সংগঠনটির নিবন্ধন ফের চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে৷ নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো যেন অনুমোদিত বিদেশি অনুদান কাজে লাগাতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে অনুরোধ করা হয়৷

অধিকারের ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হিসেবে উল্লেখ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পাওয়া শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত থাকা উচিত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলেও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়৷

বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুমের অভিযোগ তদন্তে একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দেয়া হয়৷ পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আদালতের শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়ার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে৷ প্রস্তাবে আবারো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে৷

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা তাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে ইউরোপীয় এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস, ইইউ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন৷

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলার সুযোগ নেই৷ মানুষ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে৷ গুম বন্ধ হয়নি৷ অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনা এমনভাবে ঘটছে যে তার তথ্য পর্যন্ত বাইরে যেতে পারে না৷ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক হওয়ার কোনো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি৷”

তার কথা, ‘‘আদিলুর রহমান খানকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৭ ধারায় দণ্ড দেয়া হয়েছে৷ এই ধারাটি মানবাধিকারবিরোধী ধারা৷ আমরা মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক সবাই এই ধারার বিরোধিতা করেছি৷ সেই ধারায়ই তাকে দণ্ড দেয়া হয়েছে৷ শুধু ‘অধিকার’ নয়, আরো অনেক মানবাধিকার সংগঠন চাপের মুখে আছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ অনেক মানবাধিকার সংগঠন এবং এনজিও তাদের ফান্ড রিলিজ করতে পারছে না৷ এই কারণে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কাজ ও কর্ম এলাকা কমিয়ে ফেলতে হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘সরকাররের উচিত হবে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রস্তাবে যেসব উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে তা অনুধাবন করা ৷ নির্বাচনের আগেই মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷”

এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উদ্বেগের ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ওইরকম হোলসেল কথা বলার অবকাশ নেই৷ অনেক কিছু বুঝতে হবে৷ ইতিমধ্যে এমন কিছু তো ঘটেনি যে, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে৷”

তার কথা, “গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের ব্যাপারে আমাদের হিসাব আছে৷ কতজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ কতজনের বিরুদ্ধে মামলা আছে৷ কিছু কিছু যে হয় না সেটা বলা ভুল হবে৷ যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে আমরা মামলা নিয়েছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নোটিস করেছি৷ তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে৷ আমরাও কিছু কিছু তদন্ত করেছি৷”

বিরোধী মত ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দল তো একে অপরের সঙ্গে সব সময় ঝগড়াঝাটি করেই৷ এটা আমরা সবসময়ই দেখি৷ নির্বাচনের আগে সেটা বেড়ে যায়৷ তবে সেটা যেন এমন পর্যায়ে না যায় যাতে আমাদের দুর্নাম হয়৷ আমরা তো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই৷ আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলছি৷ চিঠি দিয়েছি৷ একটা গাইডলাইন তৈরি করছি যাতে নির্বাচনের আগে ও পরে হানাহানি না হয়৷’

এসএইচ-১২/১৪/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)